চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে পোশাক কারখানায় অর্ডার কমেছে ৯ শতাংশ

নানামুখী সমস্যা নিয়ে সংকটে ধুঁকছে পোশাক শিল্প। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা মুখ খুলছেন কারখানার শ্রমিক অসন্তোষ ও জ্বালানি সংকটে চট্টগ্রামের কারখানায় অর্ডার কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। আর চলমান পরিস্থিতিতে এসব কিছু পর্যালোচনা করেই এ শিল্পে আগ্রহ ফেরানোর আশ্বাস বায়ারদের।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ছোট-বড় মিলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পোশাক কারখানার সংখ্যা ৬৬৪টি। এরমধ্যে সচল রয়েছে প্রায় ৬০০টি। প্রায় সবগুলো কারখানা ব্যস্ত সময় পার করছে স্প্রিং সিজনের (বসন্ত মৌসুম) ক্রয়াদেশ অনুযায়ী উৎপাদনের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হলেও ৮টি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকে ৮দিন। এরমধ্যে চলতি মাসে সিইপিজেড, কালুরঘাট, সীতাকুণ্ড, কেইপিজেড ও কালুরঘাট শিল্প এলাকায় বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে ৮ বার।

এ নিয়ে চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের সিনিয়র সহকারী সুপার রনজিৎ বড়ুয়া বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কিছু শ্রমিকদের আন্দোলন হয়েছে। অধিকাংশ আন্দোলন হয়েছে বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে। কারখানার মালিকপক্ষ বা ম্যানেজমেন্ট ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পারার কারণে বেতন পরিশোধ করতে দেরি করেছে। তবে এ আন্দোলনগুলো কয়েকঘণ্টার মধ্যে মীমাংসা হয়েছে।’

সাগরিকা গার্মেন্টসের মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) বিশাল মজুমদার বলেন, ‘শ্রমিক আন্দোলন চট্টগ্রামে হলেও এর প্রভাব চট্টগ্রামে নেই। চট্টগ্রামে প্রভাব ফেলেছে সারাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। এরমধ্যে বিশেষ করে ঝুট ব্যবসা নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের বিরোধের কারণে আমরা বেশ আতঙ্কিত। বাইরের গণ্ডগোল যদি কারখানার ভেতরে চলে আসে সেটা খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। এটা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক কোনো ভূমিকাও দেখছি না।’

কাট্টলীর ভ্যানগার্ড ড্রেসেস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক নাফিদ নবী বলেন, ‘বিদ্যুতের সমস্যাটা খুব বেশি হচ্ছে। কাজের সময়টাতে কয়েক দফায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্ন হওয়ায় আমাদের জেনারেটরের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে আমার প্রোডাকশন কস্ট (উৎপাদন খরচ) বেড়ে যাচ্ছে। গ্যাসের সরবরাহেও কিছুটা ঝামেলা হচ্ছে। তবে এ সমস্যাটা সাধারণত ফিনিশিং পর্যায়ে বেশি হয়। আমাদের কারখানায় ফিনিশিং পর্যায়ের কাজ কম হওয়ায় এর প্রভাব খুবই কম।’

নতুন অর্ডার ও বায়ারদের আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের শুরুতে বায়ারদের কাছ থেকে আমরা বেশ আশ্বাস পেয়েছি। তবে সম্প্রতি ঢাকার গাজীপুর ও আশুলিয়ায় বেশ কিছু সমস্যার কারণে বায়ারদের আনাগোনা এখন অনেকটা কমে গেছে। আমরা যতদূর মনে করি, বায়াররা অভজারভেশনে আছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ঠিকঠাক হওয়ার প্রেক্ষিতে হয়তো বায়াররা তাদের অর্ডার দিবে।’

একই প্রসঙ্গে এশিয়ান গার্মেন্টসের নির্বাহী পরিচালক ও বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক খন্দকার বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকা ও গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় আমাদের প্রোডাকশন ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার আসার পর থেকে প্রায় ১৫ দিন আমরা এ ব্যবসায় বিভিন্ন সম্ভাবনা দেখেছি। বায়াররাও আমাদের বিভিন্নভাবে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু এরমধ্যে আশুলিয়ায় শ্রমিকরা অযৌক্তিক কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে। এ নিয়ে ওখানকার পরিস্থিতি ভালো না। ফ্যাক্টরিগুলো প্রোডাকশনে যেতে পারছে না। তাই আমাদের প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ অর্ডার কমে গেছে। অর্ডারগুলো ভারত, নেপালসহ পাশের দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে।’

গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে কথা হলে পৃথক দুইটি সংস্থা জানান এ মুহূর্তে দুইটির কোনটিতেই সংকট নেই। যদি সংকট থেকেও থাকে তা নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগও দেয়নি।

এ নিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণ অফিসের প্রধান প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমাদের চট্টগ্রামের যে প্লান্টগুলো আছে, সেগুলো থেকে আমাদের চাহিদার দ্বিগুণ বা তার বেশি উৎপাদন আছে। তবে এটি সরাসরি জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়। সেখান থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাই এবং তা পর্যাপ্ত। এখন লোডশেডিং নেই। তবে মেইনটেন্যান্সের কাজের জন্য অনেক সময় ১৫-২০ মিনিট বিদ্যুৎ থাকে না। এটিও না হলে তো গ্রাহকদের সরবরাহ ও বিতরণ ঠিকভাবে রাখা যাবে না।’

একই সুরে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের অপরেশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, ‘এখন জিটিসিএল থেকে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছি। গ্রাহক পর্যায়েও কোনো সংকট নেই। আর শিল্প লাইনের জন্য তো আমাদের আলাদা করেই বরাদ্দ থাকে। বর্তমানে আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা ২৭০ থেকে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুটের। এরমধ্যে শিল্প লাইনের জন্য ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট ও সিএনজি লাইনের জন্য ৫ মিলিয়ন ঘনফুট বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া আমরা এলএনজি আপস্ট্রিমের গ্রাহক হওয়ায় গ্যাসের চাপেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

চট্টগ্রামের ক্রয়াদেশের হালচাল জানতে কথা হয় বিদেশি বায়িং প্রতিষ্ঠান হ্যাব্বাড ব্র্যান্ডের মার্চেন্টডাইজার রবিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখানে মূল সমস্যাটা হচ্ছে আশুলিয়ায়। ওখানে শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে, কারখানা চালু রাখছে না। আমরাতো বিভিন্ন গার্মেন্টসে অর্ডার দিই। এ অবস্থায় আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হলো- শিপমেন্ট ঠিক সময়ে করা। আমাদের অনেক অর্ডার ইতোমধ্যে আমরা শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও চীনে ট্রান্সফর্ম করেছি। এক্ষেত্রে আমাদেরও সমস্যা হচ্ছে। যেখানে ওয়েজ কস্ট ৫ ডলার ছিলো, সেখানে ৬ ডলার করতে হচ্ছে। এটা নিয়ে কনজ্যুমারদের মধ্যেও অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে যদি বলি, নতুন অর্ডারতো আসছেই না। রিপিট অর্ডারগুলোও বাদ পড়ছে। ব্যবসায়ীরা সরকারের সহযোগিতায় যদি কারখানা চালু রাখতে পারে, তাহলে অর্ডার আনা অসম্ভব।’

এ বিষয়ে বিজিএমইএ চট্টগ্রাম রিজিয়নের পরিচালক ও আর্জেন্টা গার্মেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাকিব আল নাসের বলেন, ‘আশুলিয়ার কারণে বায়াররা পুরোদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা তো স্বাভাবিকভাবে কোনো গণ্ডগোলে থাকতে চাইবেন না। এখন স্প্রিং সিজনের প্রোডাকশন চলছে। এ সময়ে আমাদের অর্ডার হয় আনুমানিক ১২ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে আমরা অলরেডি ২ বিলিয়ন ডলার মিস করেছি। আর এ পরিস্থিতি যদি ঠিক না হয় তাহলে আমরা ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার মিস করার শঙ্কা রয়েছে। অলরেডি ৯ শতাংশ অর্ডার মিস। তাই এ বিষয়ে আমরা দ্রুততার সঙ্গে সরকারের আন্তরিক ভূমিকা কামনা করছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *