চট্টগ্রাম কারাগারে কয়েদির ‘আত্মহত্যা’, নেপথ্যে কী?
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মো. ইব্রাহিম নেওয়াজ ৩০) নামে এক কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। তার গলায় ফাঁসির দড়ির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এছাড়াও ডান হাতের চামড়া উঠে গেছে। জিহ্বা কামড় দেওয়া ও জিহ্বা দিয়ে লালা পড়েছে। পুরুষাঙ্গে বীর্য ঝরেছে। তার লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কারা কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক অশান্তির কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ইব্রাহিম আত্মহত্যা করেছেন।
নিহত ইব্রাহিম নেওয়াজ রাঙ্গামাটির কোতোয়ালী থানার আলমদক এলাকার নেওয়াজ বাড়ির আলী নেওয়াজের ছেলে। তার কয়েদি নম্বর ৭৯৫৩/এ । তিনি রাউজান একটি অস্ত্র মামলার ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি এবং কারাগারের যমুনা-১৯ নম্বর ওয়ার্ডে থাকতেন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মরত একজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে জানান, অনিচ্ছার পরও কারাগারে কয়েদি সিআইডিরা (কারাগারে যারা সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা হয়, এদের মধ্যে একদলকে তথ্য অনুসন্ধানে নিয়োজিত করা হয়, যারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে তল্লাশি চালাতে পারেন, তাদেরকে কারা কয়েদি সিআইডি বলা হয়) ইব্রাহিমকে জোরপূর্বক গুদামের সবচেয়ে পরিশ্রমী কাজে দিয়েছিলেন। আর তা সইতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করছি।
তিনি আরও জানিয়েছেন, গত সোমবার বিকেল থেকে ইব্রাহিমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সন্ধ্যায় ইফতারের পর কারাগারের গুদামের পাশে তার মরদেহ পাওয়া যায়।
পুলিশ জানায়, গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ইব্রাহিমের মরদেহের সুরতহাল করা হয়। অর্থাৎ মৃত্যুর প্রায় ১৫ ঘন্টা পর তার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এর আগে গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইব্রাহিমের মরদেহ আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মহিন উল্লাহ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি তাকে মৃত আনা হয়েছে বলে জানান।
কারাগারে থাকা একাধিক বন্দি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে জানান, কারাগারে হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি মাজহারুল ইসলাম ফরহাদ নিয়োজিত আছেন চিফ রাইটার হিসেবে। তার নেতৃত্বে পুরো কারাগারে আছে ক্যাশ টেবিল রাইটার, মেডিকেল রাইটার, বিভিন্ন দফার ইনচার্জসহ বেশ কয়েকজন রাইটার (কারাগারে লেখালেখি ও ডাকাডাকির কাজে নিয়োজিত)। তাদের মধ্যে সিআইডি শওকত, সিআইডি রূপন, আব্দুল খালেক, মাসুম, ইয়াকুব, মনা, জয়নাল বাবুর্চি অন্যতম। এরাই কারাগারে পানি, ক্যান্টিন, সিট বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে।
তারা আরও জানান, ইব্রাহিম ছিলেন একজন কল রাইটার। এতোদিন তিনি সেই কাজ করলেও সম্প্রতি তার কাছে টাকা দাবি করা হয়। পরে টাকা না দিলে তাকে গত কয়েকদিন আগে কয়েদি সিআইডিরা গুদামের কাজে দিয়ে দেন। কারাগারে কাকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ন্ত্রণ করেন চিফ রাইটার মাজহারুল ইসলাম ফরহাদ। সাধারণত কারাগারে গুদামের কাজে কেউ নিয়োজিত হতে চান না। কেননা কারাগারের গুদামে কঠোর খাটুনির কাজ করতে হয়। যা অনেকেই সইতে পারেন না। ইব্রাহিম নেওয়াজকে গুদামের কাজে দেওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে তারা ধারণা করছেন।
এই ঘটনা তদন্তে ৪ সদস্যের কমিটি করেছে কারা বিভাগ। ডিআইজি প্রিজনের নেতৃত্বে উক্ত কমিটিতে কারাগারের একজন সহকারী সার্জন, একজন জেল সুপার ও একজন জেলারকে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, নিহতের মরদেহ সকল প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বন্দিদের কাজ সময়ে সময়ে পরিবর্তন করা হয়, যা কারা বিধি মোতাবেক সঠিক আছে। উক্ত বন্দিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। তাছাড়া যেকোনো বন্দি আবেদন করে কাজ পরিবর্তন করার সুযোগ সবসময়ই রয়েছে। তার কাজ পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ তিনি অথবা অন্য কেউ কখনো করেননি। তার স্ত্রী অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
এদিকে নিহতের মরদেহের সুরতহাল করেছেন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এসময় পুলিশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কোতোয়ালী থানার এসআই শামসুল ইসলাম। তিনি বলেন, চিকিৎসকের দেওয়া তথ্যমতে নিহতের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরে করা হয়েছে। সেসময় একজন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন। তার ডান হাতের চামড়া সামান্য উঠে গেছে। জিহ্বা দিয়ে লালা পড়েছে এবং পুরুষাঙ্গে বীর্যের মতো দেখা গেছে। গলায় ফাঁসির রশির দাগ পাওয়া গেছে। আশা করছি, ময়নাতদন্তে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উঠে আসবে।