খেলা

টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় অর্জন, কী বার্তা দিল টাইগাররা

নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাফল্যের দেখা পেল বাংলাদেশ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার তিন বছরের মাথায় একটা টেস্ট সিরিজ, যেটির শেষ দুই টেস্টে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের লিড নেওয়ার অকল্পনীয় ঘটনা ঘটেছে।

শেষ টেস্টে আবার জিততে জিততে ১ উইকেটে হারের দীর্ঘশ্বাস। অকল্পনীয়; কারণ, এর আগের ২১টি টেস্টের ১৫টিতেই ইনিংসে হেরেছে বাংলাদেশ। বাকি ৬টি টেস্টেও উইকেটের ব্যবধানে সর্বনিম্ন পরাজয় ৭ উইকেটে, রানের হিসাবে যা ২৮৮ রান।

যে একটিমাত্র টেস্টে হারতে হয়নি, সেটি পুরোই বৃষ্টির আশীর্বাদ। শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেও টানা দুই টেস্টে লিড নেওয়ার কৃতিত্বই তাই ওই সিরিজটিতে সেরার তকমা লেগে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের হতশ্রী পারফরম্যান্সের কারণে এরপরও আরও অনেক দিন যা ‘সেরা’ই হয়ে থেকেছে।

যে দেশে, যে দলের বিপক্ষে ওই সিরিজ, ২১ বছর পর সেই পাকিস্তানের মাটিতেই পাকিস্তানের বিপক্ষে লেখা হলো টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সুন্দরতম গল্পটা। যেটিকে বাংলাদেশের সেরা টেস্ট সিরিজ বলে ঘোষণা করে দিতে দুবার ভাবতে হচ্ছে না। শুধু টেস্ট ক্রিকেটেই-বা আটকে থাকা কেন, পাকিস্তানকে পাকিস্তানের মাটিতে ধবলধোলাই তো সব মিলিয়েই বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেরা সাফল্য।

বাংলাদেশ এর আগেও চারটি টেস্ট সিরিজ জিতেছে। এর তিনটিতেই প্রতিপক্ষকে ধবলধোলাই করে, যার দুটি আবার প্রতিপক্ষের মাটিতে। তবে পাকিস্তান জয়ের সঙ্গে সেসবের তুলনাই চলে না। কোথায় বিগতযৌবনা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ে, আর কোথায় পাকিস্তান! দেশের মাটিতে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রেকর্ড ভালো নয়, তাই বলে বাংলাদেশ পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানকে এভাবে উড়িয়ে দেবে-এটা কে কল্পনা করেছিল!

‘উড়িয়ে দেওয়া’ কথাটা কি একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে? সিরিজ ২-০ হয়েছে বলেই এমন বলা হচ্ছে না। দুই টেস্টে জয়ের ব্যবধানটাও মনে করিয়ে দিই। প্রথম টেস্টে জয় ১০ উইকেটে, শুধু ইনিংসে জয়ই যেটির চেয়ে বড় হতে পারে। বৃষ্টির কারণে চার দিনের ম্যাচে পরিণত দ্বিতীয় টেস্টে জয় ৬ উইকেটে, সেটিও চতুর্থ ইনিংসে ১৮৫ রান তাড়া করতে নেমে।

ভুলে যাওয়ার কথা নয়, তারপরও কি এটা মনে করিয়ে দেব যে প্রথম ইনিংসে ২৬ রানে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ৬ উইকেট। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে টেস্ট জেতাটাকে যদি ক্রিকেটীয় রূপকথা না বলেন, তাহলে কোনটিকে বলবেন! সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে লিটন ও মিরাজের ১৬৫ রানের ওই জুটিটাও কি তা-ই নয়!

মিরাজের ওই পাল্টা আক্রমণ, লিটনের ধ্রুপদি টেস্ট ব্যাটিং এমনিতেও স্মরণীয় হয়ে থাকত। এখন তো রেকর্ড বইয়েই লেখা হয়ে গেছে তাদের নাম। এরপর এত কম রানে ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বলার মতো কোনো জুটি হলেই উচ্চারিত হবে তাদের নাম। ১৩৮ রানের ওই ক্ল্যাসিকের জন্য ম্যাচসেরার স্বীকৃতি পেয়েছেন লিটন। বিশ্বমানের এক অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে মেহেদী হাসান মিরাজ পেয়েছেন সিরিজ-সেরার। তবে বাংলাদেশের জন্য এই সিরিজ এমনই ‘সবে মিলি করি কাজ’-এর উদাহরণ যে নায়ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে আরও। মুশফিকুর রহিম, সাদমান ইসলাম, নাহিদ রানা, হাসান মাহমুদ, তাসকিন আহমেদ…।

প্রথম টেস্টে জয়ের ভিত গড়ে দেওয়া মুশফিকুর রহিমের ওই ১৯১ রানের ইনিংসটি কীভাবে ভুলে যাবেন! অথবা মাহমুদুল হাসান চোটে না পড়লে যার খেলাই হয় না, প্রায় আড়াই বছর পর টেস্ট খেলতে নেমে সাদমান ইসলামের ওই ৯৩। ব্যাটিং-স্বর্গ মনে হতে থাকা উইকেটে পঞ্চম দিনে বাংলাদেশের দুই স্পিনারের জেগে ওঠা, যাদের একজন সম্ভবত জীবনে সবচেয়ে বেশি চাপ নিয়ে খেলা সাকিব আল হাসান।

দ্বিতীয় টেস্টের ব্যাটিংয়ে লিটন-মিরাজের আলোকচ্ছটায় বাকি সবাই অদৃশ্যই প্রায়। আরও বেশি পেসারদের অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে। শরীফুলের চোটে দলে আসা তাসকিন ১৪ মাস পর টেস্ট খেলতে নেমে উইকেট নিয়েছেন প্রথম ওভারেই। পরে আরও ২ উইকেট নিয়ে সুরটা বেঁধে দেওয়ার কাজটাও তার। দ্বিতীয় ইনিংসে ১ উইকেট নিয়ে তাসকিন পার্শ্বনায়কের ভূমিকায়; কারণ, নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা।

এই তিনজন মিলেই তুলে নিয়েছেন পাকিস্তানের ইনিংসের ১০ উইকেট, টেস্ট ক্রিকেটে এই প্রথম বাংলাদেশের পেসারদের এমন একচ্ছত্র রাজত্ব। কীর্তিটা পাকিস্তানে বলে আরও বেশি তাৎপর্যবহ হয়ে উঠছে। পেসারদের দেশ পাকিস্তান কত কিংবদন্তি ফাস্ট বোলারেরই না জন্ম দিয়েছে। সেই পাকিস্তানে গিয়ে বাংলাদেশের পেসারদের এমন দাপট চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস হতে চায় না।

৫ উইকেট নিয়ে হাসান মাহমুদ হয়তো সফলতম, তবে ক্রিকেট-বিশ্বকে চমকে দেওয়ার কাজটা করেছেন নাহিদ রানা। গতির ঝড় তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েই পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, কী দর্শনীয়ভাবেই না সেই কথা রেখেছেন এই তরুণ! ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই গতি তো প্রায় নিয়ম করেই ছুঁয়েছেন, একসময় তা পেরিয়েও গেছেন। অভিষেক টেস্টে নাহিদের বলে শুধু গতির ঝড়ই ছিল, এখন এর সঙ্গে নিয়ন্ত্রণও যোগ হওয়ার পুরস্কার ৪ উইকেট। শুধু সাফল্যে নয়, বাংলাদেশের পেসারদের কাছে গতিতেও হারছেন পাকিস্তানি পেসাররা-চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে না চাওয়ার কথাটা তো এমনিতেই বলা হচ্ছে না।

বাংলাদেশের পেস আক্রমণ এমন ধারালো হয়ে ওঠার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। টেস্ট ক্রিকেটে একটা দিনবদলের গান বাজার সঙ্গেও যেটিকে মিলিয়ে নেওয়া যায়। গত আট টেস্টের পাঁচটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের নতুন দিনের সূচনাটা কি তাহলে হয়েই গেল?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *