রাজনীতি

দেশজুড়ে সিরিজ মামলা, ন্যায়বিচার ঝুঁকিতে আসামিরা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশজুড়ে সিরিজ মামলা হচ্ছে। এমনকি প্রায় ১০ বছর আগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা উল্লেখ করেও মামলা দায়ের হচ্ছে। এসব মামলায় আসামি করা হচ্ছে ব্যবসায়ী, প্রবাসী, অভিনেতা, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, আমলাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষদের। এসব আসামির অনেকেরই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার বিষয়টি অস্পষ্ট। কিছু মামলার যৌক্তিকতা নিয়েও কথা উঠছে। কিছু মামলার ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও। অনেকের মতে, এই মামলাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢালাওভাবে মামলাগুলোর কারণে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলি, সংঘর্ষ ও বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় গত ১৬ জুলাই থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ৭৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থী, নারী, শিশু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ ঘটনাস্থলে আবার কেউ চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের করা কোনো কোনো মামলায় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় বিরোধের জেরেও কোনো কোনো ব্যক্তিকে অন্য অনেকের সঙ্গে মামলায় আসামি করার অভিযোগ আছে।

আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। কিন্তু যে মামলাগুলো হচ্ছে, তাতে বেশির ভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা’ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের মামলা আদালতে টিকবে, এমন সম্ভাবনা কম। তাই ভুক্তভোগীরা যাতে ন্যায়বিচার পান, সে জন্য থানায় বা আদালতে মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই–বাছাইয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।

মামলার বাদীরা বলছেন, পরিচিতজনদের পরামর্শে আসামিদের নাম মামলায় উল্লেখ করেছেন তারা। আবার কেউ তাঁর করা মামলায় আসামিদের দীর্ঘ তালিকার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

কোনো কোনো মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৩৯৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো মামলায় নাম উল্লেখের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে। মামলার আসামিরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এবং নেতাকর্মীরা। আবার কিছু মামলায় বিগত সরকারের সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। কিছু মামলায় সাংবাদিকসহ রাজনীতি না করা ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন।

অবশ্য ঢালাওভাবে মামলা দেয়ার বিষয়টি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। গত ২৮ আগস্ট গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যেকোনো মানুষের বিরুদ্ধে শত্রুতা থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। মামলাগুলো নেওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যাতে যাচাই করে নেয় যে কোনটি সম্ভব, কোনটি সম্ভব নয়। প্রাথমিক যে তদন্ত, সেটা করা দরকার, তা না হলে একটু ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলে তার নাম দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, এ ধরনের মামলা আন্দোলনের ফসলকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ঢালাওভাবে মামলা ও আসামি করা হলে যাঁরা অপরাধ করেছেন অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতি করেছেন, তাঁরাও আগের মতো পার পেয়ে যেতে পারেন।

বিগত সরকারের মতো গতানুগতিকভাবে গণহারে এভাবে মামলা হতে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলে মনে করছেন আইনজীবীরাও। তাঁরা বলছেন, অতীতে করা হয়েছে, তাই বর্তমানেও করতে হবে—এমন চিন্তা ঠিক নয়। এজাহার ও বিষয়বস্তুর ওপরই মামলার ভাগ্য নির্ভর করে। যেমন জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে ঢাকার আদাবর থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। ঘটনার সময় সাকিব ছিলেন দেশের বাইরে। এ রকম অনেক আসামি আছেন, যাঁরা ঘটনার সময় দেশে ছিলেন না।

উচ্চ আদালতে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে থাকেন আইনজীবী খান খালিদ আদনান। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই ময়নাতদন্ত হয়নি। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ণয় করার জন্য ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অপরিহার্য। হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে এজাহার বা নালিশি দরখাস্তে সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায়-উদ্দেশ্য উল্লেখ করতে হয়। মামলাগুলোতে আসামিদের নামের পাশে শুধু হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা উল্লেখ করা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলায় যিনি গুলি করেছেন, তাঁকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়নি। যিনি গুলি করলেন, তাঁকে শনাক্ত না করা গেলে যিনি নির্দেশ দিলেন, তাঁকে আইনের দৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্ত করা দুরূহ। যে কারণে এসব মামলা টেকার সম্ভাবনা খুবই কম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *