পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘হাতকড়া’ নেই, পাত্তা দেয় না অপরাধীরা!
পুকুর ভরাট, পাহাড় কাটা, ফসলি জমির টপসয়েল কাটা, অবৈধ ইটভাটাসহ ‘পরিবেশবিরোধী’ কী চলছে না চট্টগ্রামে। এসব নিত্যদিনকার ‘ওপেন সিক্রেট’ অপরাধ হলেও কাউকেই ‘হাতকড়া’ পরিয়ে আনতে পারছে না পরিবেশ অধিদপ্তর। সংস্থাটির জেলা-বিভাগীয়-মহানগর কার্যালয়ে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নেই। ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য জেলা প্রশাসনই তাদের একমাত্র ভরসা। শুধু ম্যাজিস্ট্রেট নয়, অন্যান্য জনবল সংকটেও ভুগছে সংস্থাটির চট্টগ্রাম অঞ্চল ও মহানগর কার্যালয়। কোথাও পরিদর্শকের অভাব, কোথাওবা সহকারী পরিচালক-উপ পরিচালকের। অনেকটা যেন ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ে একজন পরিচালক, দুজন উপ-পরিচালক, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, পাঁচজন সহকারী পরিচালক, একজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা এবং ৬ জন পরিদর্শকসহ একজন সিনিয়র টেকনিশিয়ানের পদ রয়েছে। এর মধ্যে উপ-পরিচালক-২, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, একজন সহকারী পরিচালক ও দুজন পরিদর্শকের পদ শুণ্য।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়ে পরিচালকের পদ শুন্য দীর্ঘদিন ধরে। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দায়িত্বভার চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাসের ওপর। এ কার্যালয়ে একজন উপ-পরিচালক, তিনজন সহকারী পরিচালক ছাড়া কেউই নেই। খালি পড়ে আছে একজন সহকারী পরিচালক ও তিনজন পরিদর্শকের চেয়ার।
বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় কাজ করতে বেহাল অবস্থায় পড়তে হয় সংস্থাটির কর্মকর্তাদের। নিয়মিত পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাটের অভিযোগ আসলেও ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় হুট করে চাইলে অভিযানে যাওয়া যায় না। অভিযান পরিচালনায় ম্যাজিস্ট্রেট আনতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনে ধরনা দিতে হয়। নিজেরাও এদিক-ওদিক ছুটোছুটির জন্য অভিযান পরিচালনায় খুব একটা আগ্রহী হন না। অথচ চট্টগ্রাম অফিসে একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিলো ২০২২ সালে। এরপর নিয়মিত ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও এখনও পর্যন্ত কোনো সাড়া পায়নি দপ্তরটি।
পরিবেশের ক্ষতি রোধে অভিযোগ, মামলা ও অভিযান নিয়ে জানতে গত ৬ জুন চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠান শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চল, জেলা, মহানগর অফিস ও গবেষণাগার গিয়ে অধিকাংশ কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। অফিসে পরিচালকসহ কয়েকজনকে দেখা গেলেও তারা এসব নিয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এমনকি পরিবেশ দিবস পালনে মূল প্রবন্ধেও তারা উল্লেখ করতে পারেননি পুরো বছর ধরে তারা কী কী কাজ করেছেন।
তবে লোকবল নিয়ে কথা হলে পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা খবর পেলে ঘটনাস্থলে যাই। কিন্তু আমাদের নিজের দাপ্তরিক দায়িত্বের পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজও করতে হয় । তাই আমাদের পক্ষে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা আসলে সম্ভব হয় না। যদি আপনারা আমাদের খবর দেন, আমরা সেখানে পরিদর্শন করি। আর অভিযান পরিচালনা বলতে যা বোঝায়, আমরা আসলে তা করতে পারি না। অভিযানে যেতে প্রশাসন ও পুলিশ সবার সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়।’
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ‘সরকারি অফিস সবগুলোতেই লোকবল কম। লোকবল পর্যাপ্ত থাকলে কাজ আরও ভালো হতো। তবে লোকবল নেই, কী আর করা! এসব আমাদের হেড অফিস ও মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার।’
পরিবেশ রক্ষা নিয়ে জানতে চাইলে পরিবেশবিদ ড. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘সক্ষমতা না থাকলে, লোক দেখানো অফিস রেখে তো লাভ নেই। তারা বহুদিন ধরে বলছে, লোকবল বাড়াবে, সক্ষমতা বাড়াবে। কিন্তু এখনও আমরা কোনো পরিবর্তন দেখতে পাইনি। চট্টগ্রামে আগে যে পরিমাণ পাহাড় ছিল, এখন আর নেই। পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে অনেক কথা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তাই পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে আন্তরিক হয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে হবে।’
লোকবল পর্যাপ্ত করার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘লোকবল সংকট আছে। বিভাগীয় অফিসগুলোতেও ম্যাজিস্ট্রেট নেই। এ বিষয়গুলো বলতে বা শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরে লোকবল বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দেড় বছর ধরে লোকবল কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। বেশ কিছু নিয়োগ পাইপ লাইনে রয়েছে। প্রত্যেকটি বিভাগীয় অফিসে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ার পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে। এজন্য আমাদের যে অর্গানোগ্রাম আছে, সেটি পরিবর্তন করা হচ্ছে।’
জনবল কাঠামো পরিবর্তনে আরও কত সময় লাগতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ে আমরা এই পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবো। তবে কিছু বিষয় মন্ত্রণালয় নির্ভর। আমরা মন্ত্রণালয়ে চাহিদা দিয়েছি। এরপরও আইন দিয়ে সব কিছু করা যায় না। মানুষ যদি সচেতন হয়, তাহলে পরিবেশ রক্ষা নিয়ে এতো কথার প্রয়োজন হয় না। এজন্য আমরাও মানুষকে সচেতন করার জন্য বেশ কিছু উদ্যেগ গ্রহণ করেছি।’