ধর্ম

মাহে রমজানে করণীয় ও বর্জনীয়

রোজার প্রতিটি মুহূর্ত মর্যাদাপূর্ণ। প্রতিটি নেকিকে আল্লাহ বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন। এখানে রমজানে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে আলোচনা করা হলো— রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। এটা এ মাসের বিশেষ আমল। সব আদব রক্ষা করে পুরো মাস রোজা রাখা প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য। আমরা নিয়ত সুন্দর করে রোজাগুলো আদায় করব।

কোরআন মজিদ তিলাওয়াত : এ মাস কোরআন অবতরণের মাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) জিবরিল (আ.)-এর সঙ্গে রমজানের প্রত্যেক রাতে কোরআন মজিদ দাওর করতেন (একে অন্যকে শোনাতেন)।

হাদিস শরিফে এসেছে, জিবরিল (আ.) রমজানের শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে কোরআন শোনাতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০২)

বিশিষ্ট সাহাবি ইবনে মাসউদ (রা.) রমজানে প্রতি তিন দিনে এক খতম কোরআন পাঠ করতেন। (ফাজায়েলে কোরআন, পৃষ্ঠা ১৮০)

কাতাদা (রহ.) বছরব্যাপী তাহাজ্জুদ নামাজে প্রতি সাত রাতে কোরআন খতম করতেন। রমজান মাসে প্রতি তিন দিনে এক খতম আর শেষ দশকে প্রতি রাতে এক খতম কোরআন পাঠ করতেন। (লাতায়েফুল মায়ারিফ, পৃষ্ঠা ১৭১)

কাসেন নানুতুবি (রহ.) রমজানে হজের সফরে ছিলেন। সঙ্গে কোনো হাফেজ ছিল না। তাই তিনি প্রতিদিন এক পারা কোরআন মুখস্থ করে তারাবি পড়াতেন। এভাবে তিনি হাফেজ হয়েছিলেন। (আকাবির কা রমজান, পৃষ্ঠা ২৩)।

অতএব, আমাদের প্রত্যেকের উচিত রমজানে বেশি পরিমাণে কোরআন তিলাওয়াত করা।

দান করা : দান-সদকা সর্বাবস্থায়ই উৎকৃষ্ট আমল, কিন্তু রমজানে এর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার সব মানুষের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হতো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯০২)

তারাবি : রমজানের রাতের বিশেষ আমল হলো কিয়ামে রমজান তথা তারাবি। এ মাসের অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাত লাভ করার জন্য এবং প্রতিশ্রুত সওয়াব ও পুরস্কার পাওয়ার জন্য তারাবি নামাজের প্রভাব অপরিসীম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় তারাবির সালাত আদায় করবে, আল্লাহ তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (বুখারি)

নফল ইবাদত : এ মাসে শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে। এই সুযোগে বেশি পরিমাণে নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করা যায়। অন্তত বিভিন্ন সময়ের নফল নামাজগুলো আদায় করা যেমন—ইশরাক, চাশত, তাহাজ্জুদ ইত্যাদি।

ভালো কাজ বেশি বেশি করা : এই মাসে একটি ভালো কাজের বিনিময়ে অনেক নেকি অর্জন করা সম্ভব। কাজেই প্রত্যেক মুমিনের উচিত যথাসম্ভব ভালো কাজ করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এই মাসের প্রতি রাতে একজন ঘোষণাকারী এই বলে আহ্বান করতে থাকে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী, তুমি আরো অগ্রসর হও। হে অসৎ কাজের পথিক, তুমি অন্যায় পথে চলা বন্ধ করো। তুমি কি জানো, এই মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন? (তিরমিজি, হাদিস : ৬৮৪)

দোয়া করা : এ মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও জান্নাত লাভের মাস। তাই বেশি বেশি আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়ে কান্নাকাটি করে দোয়া করা একান্ত কাম্য।

মাগফিরাত কামনা করা : যে ব্যক্তি রমজান পেয়েও নিজের গুনাহ ক্ষমা করাতে পারল না, তার ওপর জিবরিল (আ.) ও রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন। তাই জীবনের কৃত গুনাহের কথা স্মরণ করে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করা, বিশেষ করে ইফতার ও তাহাজ্জুদের সময় আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমা চাওয়া এবং দোয়া করা উচিত।

ইতিকাফ : শেষ দশকের মাসনুন ইতিকাফ অত্যন্ত ফজিলতের আমল। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২১)

শবেকদর অন্বেষণ : ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে রাত্রি জাগরণ করে সহস্র রজনী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও উত্তম রাত লাইলাতুল কদর তালাশ করা কর্তব্য। এই রাতের গুরুত্ব বোঝাতে পবিত্র কোরআনে পৃথক একটি সুরা নাজিল করা হয়েছে। সামর্থ্য থাকলে ওমরাহ পালন করা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এ মাসে একটি ওমরাহ পালন হজ আদায়ের সমতুল্য। (বুখারি, হাদিস : ১৮ )

ইফতার করা : রমজান মাসে ফজিলতপূর্ণ কয়েকটি আমলের মধ্যে একটি আমল হলো দ্রুত ইফতার করা, বিলম্ব না করা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করবে, সে যেন ইফতারের সময় খেজুর দিয়ে ইফতার করে। আর খেজুর না পেলে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কেননা পানি হলো অধিক পবিত্র। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৫৭)

অন্যকে ইফতার করানো : রোজাদারকে ইফতার করানো বিরাট সওয়াবের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার রোজার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। কিন্তু তাদের উভয়ের সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭৪৬)

ফিতরা দেওয়া : রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণে ফিতরা দেওয়া আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ১৫০৩)

রমজানে বর্জনীয় কাজ

বিবাদ ও বেহায়াপনা : মাহে রমজানে মুমিনকে যাবতীয় ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, অশ্লীল কথা ও বেহায়াপনা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে, বিশেষ করে গান-বাজনা এবং রেডিও, টিভি ও মোবাইলের অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে হবে। তবেই সিয়ামের সওয়াব ও উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কেউ সিয়াম পালন করবে, তখন সে কোনো মন্দ কথা বলবে না এবং বাজে বকবে না। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা লড়াই করতে আসে তখন সে যেন বলে, আমি রোজাদার। (বুখারি, হাদিস : ১৯০৪)

অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কত রোজা পালনকারী এমন আছে, (রোজা অবস্থায় মন্দ কথা ও কর্ম থেকে বিরত না থাকার ফলে) ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া রোজা থেকে সে আর কিছু লাভ করতে পারে না। অনুরূপ অনেক রাত জাগরণকারী এমন আছে যে রাত জেগে থাকার কষ্ট ছাড়া সে আর কিছু পায় না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৯০)

মিথ্যা কথা : মিথ্যাকে সব পাপের জননী বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে রোজা রেখেছে অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি, তার এই কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর কাছে নেই। (বুখারি, হাদিস : ১৯০৩)

গিবত : গিবত আমল ধ্বংসের নীরব ঘাতক। গিবতের কারণে কখন যে আপনার আমল ধ্বংস হয়ে যাবে তা বুঝতেই পারবেন না। গিবত জিনার চেয়েও জঘন্যতম গুনাহ। তাই গিবত পরিহার উচিত।

রিয়া বা লোক-দেখানো ইবাদত : রিয়া হলো লোক-দেখানো ও আত্মপ্রদর্শনকারী কাজ বা আমল। রিয়া করা শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম। শিরক হলো দুই প্রকার। আর এ রিয়া হলো ছোট শিরক। ফলে রিয়া থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।

অপচয় ও অপব্যয় : অপচয় কিংবা অপব্যয় করা খুবই বাজে ও গর্হিত অভ্যাস। পবিত্র কোরআনে অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। অপচয়-অপব্যয় ত্যাগ করার অর্থ হলো মধ্যপন্থা অবলম্বন করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *