অনিয়মে ভরা ফটিকছড়ির ৫৫ কর্মসৃজন প্রকল্প
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ৫৫টি কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পে হাজিরা খাতা না থাকা, স্কেভেটর দিয়ে মাটি ভরাট, কম শ্রমিকের উপস্থিতিসহ কাজের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ১৮টি ইউনিয়নে প্রকল্পগুলো পরিদর্শনে অনিয়মের এ চিত্র পাওয়া যায়। সরেজমিনেও প্রকল্পের তথ্যসংবলিত কোনো সাইনবোর্ডের দেখা যায়নি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অবহেলায় এসব হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তাঁরা বলছেন, এতে সরকারের অর্থের সুফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। অনিয়ম খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ চান তাঁরা।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘অভিযোগ সঠিক নয়। তবে কিছু প্রকল্পে ক্রটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এসব আমরা দেখে প্রকল্পের অর্থ ছাড় দিচ্ছি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইজিপিপি দ্বিতীয় পর্যায়ে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নে গ্রামীণ অবকাঠামো মেরামতের জন্য মোট ৫৫টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে গত ১৫ এপ্রিল থেকে। ঘুর্ণঝড় রিমাল ও বৃষ্টি থাকায় কাজ শুরু হয় আরও কিছুদিনপর। প্রকল্পে মোট শ্রমিকসংখ্যা ১ হাজার ৫৫৪ জন। দৈনিক ৪০০ টাকা হিসাবে ১ হাজার ৫৫৪ শ্রমিকের ৩৩ দিনে মজুরি দাঁড়ায় ২ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ৮০০ টাকা।
এর মধ্যে বাগান বাজার ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে ১৭১, দাঁতমারায় ৫টি প্রকল্পে ১৮০, নারায়ণহাটে ৫টি প্রকল্পে ১৪০, ভুজপুরে ৫টি প্রকল্পে ১১৫, হারুয়ালছড়িতে ৫টি প্রকল্পে ১২১, পাইন্দং-এ ৩টি প্রকল্পে ৭৮, সুয়াবিলে ৫টি প্রকল্পে ১৫৫, সুন্দরপুরে ২টি প্রকল্পে ৪৯, রোসাংগিরিতে ১টি প্রকল্পে ২৮, নানুপুরে ৩টি প্রকল্পে ১১৫, সমিতিরহাটে ১টি প্রকল্পে ৪৫, ধর্মপুরে ৩টি প্রকল্পে ৬৪, জাফতনগরে ১টি প্রকল্পে ৪৪, লেলাং-এ ৩টি প্রকল্পে ৯০, বক্তপুরে ১টি প্রকল্পে ৩৩, খিরামে ২টি প্রকল্পে ৫০, আবদুল্লাহপুরে ১টি প্রকল্পে ১৪ এবং কাঞ্চননগরে ৪টি প্রকল্পে ৮৯ জন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫৫ জন স্থানীয় ইউপি সদস্য ও মহিলা সদস্যকে প্রকল্পের সভাপতি করা হয়। প্রকল্পগুলোর সার্বিক তদারকির দায়িত্বভার ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাটি ভরাটের জন্য সপ্তাহে ছয় দিন (শনি থেকে বৃহ:বার) দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরিতে শ্রমিকদের সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। মেলে নানান অনিয়ম।
কাঞ্চননগর ইউনিয়নের কবির আহাম্মদ জামে মসজিদ থেকে ধুরুং পর্যন্ত ডলু পাড়া সড়কে মাটির রাস্তা সংস্কার প্রকল্পের কাজে ২০ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা। কিন্তু সেখানে পাওয়া গেছে ১১ জনকে। বাকী শ্রমিক ছিলেন অনুপস্থিত। হাজিরার জন্য দেখা যায়নি কোন হাজিরা খাতা।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আলমগীর বলেন, ‘প্রতিবছরই এই রাস্তাটিতে প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে রাস্তাটিতে মাটি দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যা দিচ্ছে তা আবার পানিতে ভরা কাঁদামাটি। সরকারের গৃহীত প্রকল্পের টাকা নস্ট হচ্ছে।’
কাঞ্চননগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. দিদারুল আলম বলেন, ‘অনুপস্থিত শ্রমিকদের তালিকা করছি। তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা উপস্থিত থাকছেন, কাজে আসছেন, তাঁদের তালিকা বিলের জন্য জমা দেব।’
নারায়ণহাট ইউনিয়নের নেপচুন চা-বাগান থেকে কুলাল পাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে গিয়ে কোনো শ্রমিকের দেখা মেলেনি। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. জামাল উদ্দিন জানান, ‘রাস্তাটির কিছু অংশ স্কেভেটর দিয়ে মাটি ভরাট করেছি। এলাকার উন্নয়নে তা করেছি। অন্যায় করিনি। সাথে শ্রমিকও কাজ করেছেন।’
নারায়ণহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবু জাফর মাহমুদ বলেন, ‘রাস্তার কাজে কোন অনিয়ম হচ্ছেনা। যাচাই বাছাই করে সবকিছু হচ্ছে। মানুষের প্রয়োজনে স্কেভেটর ব্যবহার করা হয়েছে।’
খিরাম ইউনিয়নে দুইটি প্রকল্পে ৫০ জন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় গিয়ে কোন কাজ দেখা যায়নি। ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. মাহফুজ এলাহী বলেন, ‘প্রকল্পের সবকিছু চেয়ারম্যান নিজেই দেখভাল করেন।
খিরাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘আমি আদালতের কাজে ব্যস্থ আছি। পরে আপনাকে জানাবো।’ তবে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি আর কিছু জানান নি।
বাগানবাজার ইউনিয়নের শফিকের দোকান থেকে কাঞ্চু মিয়ার বাড়ি সড়কে রাস্তা সংস্কারে ৩৪ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা। সম্প্রতি সেখানে সরেজমিনে কাউকে পাওয়া যায়নি।
এলাকার বাসিন্দা মো. সজিব বলেন, ‘কয়েকদিন আগে সড়কে কিছু কাজ করা হলেও বৃস্টির পানিতে সব তলিয়ে গেছে। এসব কাজ করা-না করা একই। এসব সরকারের লস প্রজেক্ট।’
বাগানবাজার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শাহাদাত হোসেন সাজু বলেন, ‘সব প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। আমি ভাল কাজের পক্ষে। ইউপি সদস্যরা কেউ অনিয়ম করলে তারা এটার দায়ভার নেবে।’
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. আবুল হোসেন আরো বলেন, ‘অনিয়ম করে কেউ পার পাবেনা। বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সবকিছু খতিয়ে দেখে প্রকল্পের অর্থ ছাড় হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ কর্মকর্তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার চলমান কর্মসূচি তদারকির কথা। বিষয়টি আমার জানা নেই। জেনে সঠিকতা যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’