আন্দোলনে আহতদের সেবাদাতাও আসামি!
মো. নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেন। নিজাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারী, আমজাদ স্পেশাল কর্মচারী। জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের চিকিৎসক পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া, রেফার রোগীদের অন্য বিভাগে নেওয়া তাদের মূল কাজ। তবু বড় বড় ঘটনা-দুর্ঘটনায় তাদের দিয়েই পরিস্থিতি সামলে নিতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। তেমনি কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নানা ঘটনায় হতাহতদের সেবা শুশ্রুষা করছিলেন তাঁরা দুজন। রোগী থেকে নিহতদের লাশ সুরতহাল তৈরিতে পুলিশকে সহযোগিতা করেছেন তাঁরাই। অথচ যে ঘটনায় প্রায় একমাসেরও বেশি তারা দিনরাত সেবা-শুশ্রুষায় ছিলেন তাদেরই করা হয়েছে ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলার আসামি!
গত ১৬ জুলাই নগরের মুরাদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে নিহত চট্টগ্রাম কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে তাদের। এছাড়া চান্দগাঁও থানায় দায়ের হওয়া আরও একটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে নিজামকে।
নিজামের কাঁধে দুই মামলা, আমজাদের এক
গত ১৮ আগস্ট পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন নিহত ওয়াসিম আকরামের মা জোছনা বেগম। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৫০ জনের নামে করা ওই মামলায় ৪২ ও ৪৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে নিজাম ও আমজাদকে।
এছাড়া গত ৪ আগস্ট বহদ্দারহাটে মো. ফজলে রাব্বী নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় নিহত রাব্বির বাবা মো. সেলিম চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগরের কয়েকটি আসনের সাবেক এমপি এবং প্রায় সব কাউন্সিলরসহ ৩৭০ জনের নামে করা ওই মামলার ৬১ নম্বর আসামি করা হয়েছে নিজামকে।
‘আসামি’ নিজাম-আমজাদকে চিনেই না পরিবার!
পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও থানায় হওয়া মামলায় বেশিরভাগ আসামিকে চিনেই না পরিবার। কলেজ শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম নিহতের ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় দায়ের হওয়া মামলার বাদী তাঁর মা জোসনা বেগম। মামলার প্রসঙ্গে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় তাঁর মুঠোফোনে। তবে ছেলের মৃত্যুর পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জোসনা বেগম। ভুগছেন নানা রকম শারীরিক অসুস্থতায়। তাঁর ফোন ধরেন ওয়াসিমের ছোট বোন সাবরিনা ইয়াসমিন।
মামলা প্রসঙ্গে সাবরিনা বলেন, ‘আমাদেরকে বলছে চট্টগ্রাম এসে সাইন করে চলে যাবেন। আমরা সাইন করে চলে আসছি।’ মামলা করতে একজন সহযোগিতা করেছেন বলে দাবি করলেও তাকেও চেনেন না বলে জানিয়েছেন ওয়াসিমের ছোট বোন সাবরিনা। তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা হত্যা করছে তাদের নাম থাকবে। আমরা বা আমার পরিবার কাউকে চিনি না। আমরা ওইদিন (১৮ আগস্ট) রাত ৮টায় সাইন করে চলে আসছি।’
সেদিন যেখানে ছিলেন দুই কর্মচারী
১৬ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নগরের মুরাদপুর এলাকায় কোটা আন্দোলন ঘিরে সবচেয়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেন কোথায় ছিলেন তা জানতে চেষ্টা চালানো হয়। অনুসন্ধানে উঠে আসে— বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয় ওয়াসিম আকরামকে। ক্যাজুয়ালিটি বিভাগে নেওয়া হলে ওয়াসিম আকরামকে কতর্ব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সেসময়টাতে নিজাম ও আমজাদ দুজনেই হাসপাতালে আনা কোটা আন্দোলনে আহতদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যার প্রমাণও পাওয়া যায় জাতীয় একটি দৈনিকে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে। সেখানে নিজাম উদ্দিনকে মর্গের সামনে রোগীদের নিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জুলাই মাসের প্রথম ১০ দিন বিকালের শিফটে ডিউটি ছিল নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেনের। দ্বিতীয় ১০দিন ছিল সকালের শিফটে (সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা)। ঘটনার দিন অর্থাৎ ১৬ জুলাই মঙ্গলবার রুটিন অনুযায়ী দুজনেরই সকাল শিফটে ডিউটি ছিল। একইভাবে ৪ আগস্ট দুপুর ২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হাসপাতালেই দায়িত্বরত ছিলেন তারা।
এদিকে, আউটসোসিং কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর এবং বায়োমেট্রিক হাজিরা নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে বায়োমেট্রিক হাজিরা বা ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হলেও সেটা একদিনের বেশি সংরক্ষণ করা হয় না! যদিও হাজিরা খাতা অনুসন্ধান করে ঘটনার দিন (১৬ জুলাই ও ৪ আগস্ট) নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেনের স্বাক্ষর পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ মোহাম্মদ মহসিন সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘যে সফটওয়ারের মাধ্যমে আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়া হয় সেটা একদিনের বেশি থাকে না। যেদিনেরটা সেদিনই পাওয়া যায়। কেবলমাত্র হাসপাতালের স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরই ডিজিটাল হাজিরার তথ্য এই সফটওয়্যারে রাখা হয়।’
একই বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘আউটসোর্সিং কর্মচারীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট এখনো চালু হয়নি। হাজিরা খাতা মেইনটেইন করা হয়। সেদিন তারা ডিউটিতে ছিল কিনা হাজিরার রেজিস্টার খাতা চেক করলেই জানা যাবে। পুলিশ ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের বের করতে পারবে। হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সিসি ক্যামেরা আছে। তারা যদি অপরাধী হয়; তবে শাস্তি পাবে আর না হলে পাবে না।’
তবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে থাকা ২২টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, এসব ক্যামেরার ফুটেজ ১৫ দিনের বেশি সংরক্ষণ করে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ!
হাসপাতালেই ছিলেন আমজাদ নিজাম— বলছেন চিকিৎসকরা
১৬ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. নুজহাত ই নুর, ডা. তুহিন শুভ্র দাশ, ডা. নিবেদিতা ঘোষ। এদিন নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেন ডিউটিতে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তাঁরা। এছাড়া সেদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করা চমেকের আউটসোর্সিংয়ের অন্তত ১০ জন কর্মচারী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তেমনি একজন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সর্দার মনির হোসেন ভূঁইয়া। তিনি সিভয়েস২৪’কে বলেন, ‘সেদিন তাদের ডিউটি সকালে ছিল। পরে রাতের ১২টা পর্যন্ত ডাবল ডিউটি করিয়েছি। দুঘর্টনা ছিল তো তাই তিন শিফটের লোককে একসাথে ডিউটি করাতে হয়েছে। ডিউটিতে আসলে এখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ নাই। কারণ সার্বক্ষণিক ডাক্তারদের সঙ্গে থাকতে হয়। আর আমিও মনিটরিংয়ে রাখি।’
আউটসোর্সিং কর্মচারী মো. নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেনের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. নুজহাত ই নুর বলেন, ‘আমি সেদিন ইভেনিং (বিকেল) শিফটে ছিলাম। আমাদের ইভেনিং ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। সেদিন তাদের (নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেন) আমি পেয়েছিলাম। যতদূর মনে আছে মর্নিংও তারা ডিউটিতে ছিল। সেদিন অনেক রোগী আসছে। আমার সঙ্গে ডা. তুহিন শুভ্র ও ডা. নিবেদিতা ছিল। ওরা দুজন আমাদের তিনজনের সঙ্গে কাজ করেছে এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আপনি চাইলে বাকিদের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন।’
একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. নিবেদিতা ঘোষ বলেন, ‘নিজাম উদ্দিন ডিউটিতে ছিল সেটা শতভাগ শিউর। তবে আমজাদের চেহারাটা মনে নাই। তাই হঠাৎ করে চিনছি না। কারণ সেদিন খুব ঝামেলা ছিল। আমরা তিনজন ডাক্তার ডিউটিতে ছিলাম। ওরটা (নিজাম উদ্দিন) জানি। একদম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ডিউটিতে ছিল ও। তাই আমার মনে আছে। আমি শিউর। তাছাড়া ওদের ফিঙ্গার বা হাজিরা খাতা চেক করলেও পাওয়া যাবে।’
এদিকে ১৬ জুলাই সকাল থেকে জরুরি বিভাগে দায়িত্বে ছিলেন ডা. তুহিন শুভ্র। নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেন ডিউটিতে ছিলেন কিনা জানতে চাইলে ডা. তুহিন বলেন, ‘হ্যাঁ তারা আমার সঙ্গে সেদিন কর্মরত ছিলেন। এমনিতে আমার শিফট বিকেলে ছিল। কিন্তু সেদিন ইমার্জেন্সি থাকায় সকাল থেকে একদম রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়েছে। ওরাও আমার সঙ্গে ডিউটিতে ছিল।’
চান্দগাঁওয়ের মামলায় ‘কপি-পেস্ট’ আসামি নিজাম
গত ২০ আগস্ট নগরের চান্দগাঁও থানায় দায়ের হওয়া মামলায় দেখা যায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ৪ আগস্ট বহদ্দারহাটে মো. ফজলে রাব্বী নামের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় নিহত রাব্বির বাবা মো. সেলিম সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগরের কয়েকটি আসনের সদ্য সাবেক এমপি এবং প্রায় সব কাউন্সিলরসহ ৩৭০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।
পাঁচলাইশের পর ওই মামলাতে এজাহারনামীয় ৬১ নম্বর আসামি করা হয় চমেকের সেই কর্মচারী নিজাম উদ্দিনকে। অথচ সেদিনও বিকেল শিফটে হাসপাতালে দায়িত্বরত ছিলেন তিনি।
ওইদিন (৪ আগস্ট) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ছিলেন ডা. মো. মুমিন উল্লাহ ভূঁইয়া। সেদিনেও অভিযুক্ত নিজাম উদ্দিন ও আমজাদ হোসেন কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চমেকের এই ডাক্তার।
জানতে চাইলে মামলার বাদী মো. সেলিম বলেন, ‘আমিতো আসলে ছিলাম না ওইখানে। যারা ছিল তারা তথ্য দিয়েছে আমার ছেলে কিভাবে মারা গেছে। জেনেছি, গত ৪ আগস্ট মাগরিবের আজানের পরপরই বহদ্দারহাটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার ছেলে মারা গেছে। সে ভোলায় একটি স্কুলে পড়ালেখা করতো।’
চাকরি ‘খেয়ে ফেলার’ সন্দেহে নাম দিলেন সহকর্মী!
চাকরি খেয়ে ফেলার সন্দেহ থেকেই মামলায় ফাঁসানো হয়েছে ধারণা নিজাম উদ্দিনের। মোহাম্মদ সোহেল নামে আরেক আউটসোর্সিং কর্মচারীর সঙ্গে নিজামের ব্যক্তিগত বিরোধ। ওই বিরোধের জের ধরে সোহেল নিজামের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার কারণে বরখাস্ত হন নিজাম। এক বছর বরখাস্ত থেকে ২০২৩ সালে আবারো চাকরিতে যোগ দেন নিজাম। চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চাকরিচ্যুত হন মোহাম্মদ সোহেল নামে ওই কর্মচারী। নিজামের ভাষ্যমতে, সোহেলের সন্দেহ, নিজামই তার চাকরি খেয়েছে!
নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বন্ধু-সহকর্মী ছিলাম। আমার সংসার ভাঙ্গার চেষ্টা এবং আমার স্ত্রীকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করায় ২০২১ সালে তার সঙ্গে আমার মারামারি হয়। ওই মারামারির ঘটনায় আমার নামে মামলা করে সে (সোহেল)। ঝামেলার কারণে এক বছর বরখাস্ত ছিলাম আমি। এরপর আমার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে মামলা থেকে নিষ্পত্তি করে দিবে বলে সাইনও নেয়। তখন থেকে তার সঙ্গে আমার দূরত্ব। গত বছর আবার জয়েন করি।’
‘স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নির্বাচনে পোস্টার লাগানোকে কেন্দ্র করে চাকরি চলে যায় সোহেলের। ওর ধারণা আমার কারণে তার চাকরি চলে গেছে। যার জন্য হত্যা মামলায় জড়িয়ে সে আমার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে।’— বলেন নিজাম উদ্দিন।
আমজাদ হোসেনকে কেন আসামি করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমজাদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। আর সবসময় আমরা একসঙ্গে কাজ করি, নাশতা করি, আমাদের ভালো বন্ধুত্ব। ওই জন্য আমজাদকেও আসামি বানিয়ে দিয়েছে সে। কোনো রকমের রাজনীতির সঙ্গে আমরা জড়িত না। সোহেল তার চাকরি চলে যাওয়ার জন্য আমাকে দায়ী ভেবে এতো বড় মিথ্যা মামলায় আমাকে ফাঁসিয়ে দিলো। বন্ধু শেষে শত্রু হয়ে গেছে। সে যে আমাকে আসামি বানাইছে সেটা আমি আরেক বড় ভাই থেকে জানতে পারছি।’
একই প্রসঙ্গে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘নিজামের সঙ্গে আমি সবসময় থাকি বলে সোহেল আমাকেও মামলায় আসমি বানিয়ে দিছে। মেডিকেলের আ জ ম নাছির গ্রুপ ও নওফেল গ্রুপ, নুরুল আজম রনি, টিনুর সঙ্গে তার উঠাবসা। আগে নিজেকে আওয়ামী লীগ দাবি করতো, সরকার পতনের পর বিএনপি দাবি করে। এখন সুযোগ পাইছে তাই হত্যা মামলার আসামি বানাই দিছে আমাদের।’
কে এই সোহেল?
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আউটসোসিং কর্মচারী ছিল মোহাম্মদ সোহেল। সরকার পতনের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেসব গ্রুপ-উপগ্রুপ আধিপত্য বিস্তার করতো তাদের অধিকাংশের সঙ্গেই সখ্যতা ছিল সোহেলের। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাঁর আরেক পরিচয় প্রকাশ্যে এসেছে। ফেসবুকের তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে নিজেকে ৩২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের আহ্বায়ক। নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে দাঁড়ানো একটি ছবি ভাসছে তার প্রোফাইলে।
মামলায় দুজনকে আসামি বানানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মোহাম্মদ সোহেল। তিনি বলেন, ‘এটা আমি কেমনে দিবো? এখানে কি আমার হাত আছে নাকি। মামলা কি আমি করছি নাকি যে আমি দিবো নাম। এটা নিয়ে আমি কিছু জানি না। আর জানলেও মোবাইলে আমি কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করতেছে না। এখন গাড়িতে তো…।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো মিথ্যা কথা। নিজাম উদ্দিন এবং আমজাদ মেডিকেলের দালাল। বিভিন্নজন নুরুল আজম রনি, বাবর আলী, রাজু হানিফদের সঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করছে মেডিকেলে। আমার নামে রুপম দাশের সঙ্গে মিলে উল্টাপাল্টা কথা বলতো। যারা মামলা করছে তারাই জানে। আমি জানি না।’
মামলা দায়েরে প্রভাব খাটাচ্ছে ‘রাজনৈতিক চক্র’!
সরকার পতনের পর থানায় থানায় হামলা, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের পর মনোবল ভেঙে গেছে পুলিশ বাহিনীর। নতুন করে কার্যক্রম শুরু করলেও অনেকটা নিরুপায় তাঁরা। সরকার পতনের পর থেকে থানায় থানায় যেসব মামলা হচ্ছে সেসব মামলার বাদী ভিকটিমের পরিবার হলেও রাজনৈতিক একটি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রভাব খাটাচ্ছে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সেখানে তাদের ব্যক্তিগত বিরোধের প্রতিপক্ষকে আসামি বানাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার পতনের পর থেকে রাজনৈতিককর্মীরা বিভিন্ন মামলায় প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন। নিজেদের মতো এজাহার এনে যার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে তাদেরও ফাঁসাচ্ছেন। আপাতত মামলা নেওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। পরে তদন্তের মাধ্যমে আমরা নির্দোষ ব্যক্তিদের অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেব।’
আতঙ্কে নিজাম-আমজাদের পুরো পরিবার
মামলায় আসামি হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই হয়রানি ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক নিজাম উদ্দীন ও আমজাদের মনে। যাচ্ছেন না হাসপাতালে। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন স্থানে।
তিন মাসের সন্তান নিজাম উদ্দীনের সংসারে। ১৯ আগস্ট বিকেলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজাম উদ্দিন বলেন, আমার একটা বাচ্চা হইছে ওটার বয়স তিনমাসও হয় নাই। বাচ্চার সঙ্গে খেলতে পারছি না, ঘুরতে পারছি না। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে এই বুঝি পুলিশ সেনাবাহিনী এসে ধরে নিয়ে যাবে। তখন আমার বউ বাচ্চা পরিবারের কী হবে?’
নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমি কোনোদিন কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমাকে ফাঁসানো হইছে। ওইদিন সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ডাবল ডিউটি করছি। ওয়াসিম আকরামসহ তিনজনের লাশের সুরতহাল করার সময় আমি নিজে পুলিশের সাথে ছিলাম। যাবতীয় কাগজপত্র রেডি করতে পুলিশকে সাহায্য করছিলাম । তখন ওসি স্যার, এসআই দীপক দেওয়ান ও ইমান হোসেন উপস্থিত ছিলেন। তারা হয়তো এখন আমাকে দেখলে চিনতে পারবেন।’
একই বক্তব্য আমজাদ হোসেনেরও। তিনিও হতাশার সুরে বলেন, ‘আমরা কোনো অপরাধ করি নাই। সকল প্রমাণ আছে। কিন্তু বিচার পাইতে পাইতে তো সময় লাগবে। এর আগেই যদি গ্রেপ্তার করে ফেলে তখন এই অপমান কীভাবে সহ্য করবো। মরা ছাড়া তো কোনো উপায় থাকবে না। অন্যায় না করেও এইভাবে অপরাধী বানাইলো এটার বিচার কোথায় পাবো?’
পুলিশ বলছে…
চমেক হাসপাতালের দুই কর্মচারী হাসপাতালে থেকেও আসামি হওয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) প্রকৌশলী আবদুল মান্নান মিয়ার সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, ‘এই মামলার বাদী কারা? নিহত ব্যক্তিদের পরিবার। এই মামলার বাদী পুলিশ না। সেখানে তো আমরা হাত দিতে পারি না। তদন্তে যদি দেখা যায় সেখানে সে (ভিকটিম) ছিল না বা কোনো ধরনের অসঙ্গতি আসে; তাহলে আইনের যে ব্যত্যয় হবে না সেটা আপনাকে জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনের সুরক্ষা প্রত্যেক ব্যক্তি পাবে। এজন্যই তো তদন্ত করা হয়। আমরা এসব মামলা নিয়ে কাজ করছি। এখনো পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করিনি। কেউই অবিচার বা হয়রানির শিকার হবেন না। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে হবে।’