কক্সবাজারচট্টগ্রাম

আরাকান আর্মি ও বিজিপির তুমুল গোলাগুলি মিয়ানমারে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে সরকারি বাহিনীর সাথে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির তুমুল সংঘাত চলমান রয়েছে।

বুধবার ভোর থেকে শুরু হওয়া একের পর এক মর্টার শেল ও ভারী গোলার বিকট শব্দে এপারে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে।

সীমান্তের বাসিন্দারা বলছেন, গত চার মাস ধরে নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষায় মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির সংঘাত চলছে। এতে ওপারের বেশ কিছু সীমান্ত চৌকি এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। ওপারে যুদ্ধের কারণে এপারের সীমান্তের টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, কায়ুকখালীপাড়া, জালিয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, কুলালপাড়া, খাংগার ডেইল, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, সাবরাংয়ের মগপাড়া, আছারবনিয়া, ডেগিল্লাবিল, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়ায় মর্টারশেল, বিমান হামলা ও বোমার বিকট শব্দে বাড়ি-ঘর কাঁপছে। চরম আতঙ্কে রয়েছেন সীমান্ত এলাকাসহ পাশ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা।

ফোনে রাখাইনে সুদাপাড়ার বাসিন্দা ফয়সাল বলেন, ‘এখনো ওপারে মিয়ানমারে তীব্র লড়াই চলছে। সকাল থেকে গ্রাম খালি করতে মাইকিং করা হচ্ছে। লোকজন না সরায় যুদ্ধবিমান দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। গইন্যা পাড়া ও গজ্জনিয়া পাড়াসহ কয়েকটি গ্রামে বিমান হামলা চালাচ্ছে জান্তা বাহিনী।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহর মংডু যেকোনো মুহূর্তে আরাকান আর্মির হাতে চলে যেতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে মংডু শহরের ৯০ শতাংশের বেশি এলাকা থেকে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি। শহরটিতে মিয়ানমারের বিজিপিসহ অন্যান্য বাহিনীর ৪ হাজার সৈন্য রয়েছে। আর এই শহরটি চারপাশে ঘিরে রেখেছে আরাকান আর্মি। এর জের ধরে গত ৩ দিন ধরে টানা চলছে উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র গোলাবর্ষণ, মর্টার শেল বর্ষণের ঘটনা। বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শুনতে পাচ্ছে নাফ নদের এপারে বাংলাদেশের মানুষ।

মিয়ানমারের মংডু থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, মংডু শহর দখলের সর্বশেষ পরিস্থিতির কারণে কয়েকটি এলাকার লাখের অধিক রোহিঙ্গার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এসব রোহিঙ্গা নাফ নদের ওপারে প্যারাবন, চাষের জমি, বন-জঙ্গলে অবস্থান করছে। যারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য নানাভাবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

তবে অনেক রোহিঙ্গা এখন সংঘাতের মাঝামাঝি এলাকায়। যাদের একপাশে আরাকান আর্মি এবং অপর পাশে বিজিপি। যাদের সরতে দিচ্ছে না মিয়ানমারের জান্তারা। অভিযোগ উঠেছে, এসব রোহিঙ্গাদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে চরম ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এসব রোহিঙ্গার জন্যে।

সূত্র বলছে, এর আগে মংডু শহরের দক্ষিণের কিছু অংশে কয়েকটি বিজিপির চৌকি ছিল। ওইসব চৌকি হয়ে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজ নাফ নদের ওপারে অবস্থান করে খাদ্য ও গোলাবরুদ সরবরাহ করত। কিন্তু গত সপ্তাহে দক্ষিণের ওইসব চৌকিও আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এতে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর জাহাজও পিছু চলে গেছে। ফলে এ পরিস্থিতিতে মংডু শহরে আটকে পড়া মিয়ানমার বাহিনীকে সহায়তা করতে পারছে না নৌবাহিনী। ফলে গোলাবরুদ ও খাদ্য সংকটে দুর্বল হয়ে পড়েছে ৪ হাজার সেনা সদস্য। এতে আর বেশিক্ষণ আরাকান আর্মির সঙ্গে টিকে থাকা সম্ভব হবে না বলে ধারণা। যেকোনো সময় মংডু শহর আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।

ওখানে আরাকান আর্মি ও সরকারি বাহিনীর মাঝামাঝি রয়ে গেছে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ। যাদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী শেষরক্ষার চেষ্টা করছে।

উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকালেও ওপারে মংডুতে যুদ্ধ বিমান দিয়ে হামলা চালানো হয়েছে। এতে হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে থাকা রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে এদিক-ওদিক ছুটছে। অনেকে আবার এপারে আসতে চেষ্টা চালাচ্ছে বলে শুনেছি।

এদিকে, সীমান্তের ওপারে রাখাইনে চলমান সংঘাতের কারণে নতুন করে বাংলাদেশে যাতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ না ঘটে সেজন্য বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড এবং সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড বিজিবি।

টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ওপারে মর্টার শেল, গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণের শব্দের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের চেষ্টার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে নাফ নদী অতিক্রম করে মিয়ানমারের লোকজনের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ড বাহিনী। গোয়েন্দা নজরদারি, টহলও বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও সীমান্তবাসীও সজাগ রয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটার জের ধরে কোনোপ্রকার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। অনুপ্রবেশ করতে দেওয়ার কোনো সুযোগও নেই। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *