দেশজুড়ে

‘ইউটিউব দেখে বাড়ির আঙিনায় আঙুর চাষ করে সফল সরোয়ার

বাড়ির আঙিনায় বাঁশের মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল, সবুজ, হলুদ রঙের রাশিয়ান মিষ্টি জাতের গোল আঙুর। চলতি পথে বাড়ির আঙিনায় রঙিন এসব ফল দৃষ্টি কাড়ছে পথচারী ও দর্শনার্থীদের। আঙুরের থোকায় কৃষি উদ্যোক্তা সরোয়ারের চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন।

বলছিলাম সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের চর বাগমারা গ্রামের সরোয়ার হোসেন বিশ্বাসের কথা। রাজবাড়ী জেলায় তিনি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম তার বাড়ির আঙ্গিনায় ২ শতাংশ জমির ওপর আঙুর চাষ করে সফল হয়েছেন।

জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও মাটির বৈশিষ্ট না জেনেই শুধুমাত্র ইউটিউব দেখে শখের বসে আঙুর চাষে আগ্রহী হন সরোয়ার। প্রথমে গাছ সংগ্রহ করে ইউটিউব দেখে নিয়মকানুন জেনে বাড়ির আঙিনায় ২ শতাংশ জমিতে শুরু করেন চাষাবাদ। এ সময় পরিবার ও আশপাশের অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তবে তিনি থেমে যাননি। প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক চাষে একটি গাছ থেকেই পেয়েছেন প্রায় দেড় মণ মিষ্টি আঙুর। এখন উদ্যোক্তা সরোয়ার হোসেন বিশ্বাস তার সংগ্রহে থাকা ৬টি জাতের পাশাপাশি ভারতের থেকে আনা ১২টি জাত সংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবে নিজের ৭০ শতাংশ জমি আঙুর চাষের জন্য প্রস্তুত করছেন।

সরেজমিনে মিশ্র ফল চাষি কৃষি উদ্যোক্তা সরোয়ার বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বসতবাড়িতে ঢোকার প্রধান ফটকেই আঙুর গাছের মাচা। মাচাটি তিনি বাঁশ দিয়ে তৈরি করেছেন। মাচার দিকে তাকালেই চোখে পড়ে বাহারি রঙের আঙুর ফল থোকায় থোকায় গাছের ডালে ডালে ঝুলছে। উদ্যোক্তা সরোয়ার একটি স্টিলের মইতে উঠে তার আঙুর গাছের পরিচর্যা করছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা তার আঙুর গাছ দেখতে আসছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কম পরিশ্রম ও কম খরচে লাভজনক হওয়ায় আঙুর চাষে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। আঙুর চাষে বাড়তি কোনো খরচ নেই। জৈব সার প্রয়োগের পাশাপাশি সঠিক পরিচর্যায় একটি গাছে ৪০ থেকে ৫০ বছর ফলন পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া বছরে একটি গাছে ৩ বার ফল আসে। প্রতিটি গাছে দেড় থেকে ২ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

কৃষি উদ্যোক্তা সরোয়ার বিশ্বাস বলেন, আমার ছাত্র জীবনে আঙ্গুর ফলের প্রতি একটা লোভ ছিল। ১৯৯৪ সালে রাজবাড়ী বিসিকের একটি নার্সারি থেকে আঙুর ফলের চারা এনে বাড়িতে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু ওই আঙুর ফল ছিল টক। সেই থেকে আমার ইচ্ছা ছিল মিষ্টি আঙুর চাষ করার। তাই মিষ্টি আঙুরের চারা খুঁজতে থাকি। গত বছর ইউটিউবে কুড়িগ্রাম জেলার আঙুরের একটি ভিডিও দেখেছিলাম। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করে সেখান থেকে একটি চারা নিয়ে এসে বাড়িতে লাগাই। চারা লাগানোর ৮ মাসে আমি ফলন পাই। ওই গাছে ৫ কেজির মতন আঙুর ধরেছিল এবং ফলটি খুব মিষ্টি ছিল। এই বছর আমি ওই গাছ থেকে প্রায় দেড় মণের মতো ফল পেয়েছি। এখন আমি চিন্তা ভাবনা করছি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার। ইতোমধ্যে আমি ৭০ শতাংশ জমি প্রস্তুত করেছি। গত সপ্তাহে ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে ১২ জাতের চারা এনেছি। বর্তমানে আমার এখানে ৬টি জাতের চারা রয়েছে।

তিনি বলেন,পৃথিবীতে মোট ৫২টির ওপরে আঙুরের জাত রয়েছে। এর মধ্যে যেগুলো সর্বসেরা সেগুলো আমি সংগ্রহ করেছি। আমার সংগ্রহে রয়েছে ইতালির দুইটি জাত, রাশিয়ার ৬টি জাত ও বাকিগুলো ভারতের। আমি পরীক্ষামূলক আঙুর চাষ করে সফল হবার পর এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ করছি। আমি একজন মিশ্র ফল চাষি। মহামারি করোনার সময় যখন বেকার হয়ে ঘরে বসেছিলাম তখন ইউটিউব দেখে মাল্টা ও কমলা চাষ করে সফল হয়েছিলাম। প্রায় ১০ বিঘা জমির ওপর আমার মিশ্র ফলের বাগান রয়েছে। প্রায় তিন বছর আমি আমার বাগান থেকে কমলা পাচ্ছি। আমি কমলা চাষেও সফল হয়েছি।

উদ্যোক্তা সরোয়ার বলেন, রাজবাড়ীতে আমি প্রথম আঙুর চাষ করেছি। কৃষি বিভাগ থেকে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই আমি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারই সফল হয়েছি। আমার একমাত্র গুরু হচ্ছে ইউটিউব। আমি ইউটিউব দেখে কমলা ও মাল্টা চাষ করে সফল হয়েছিলাম। আবার ইউটিউব দেখেই আমি আঙুর চাষ করি। আমার আঙুর অত্যন্ত মিষ্টি। বিভিন্ন দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আমার আঙুর বাগান দেখতে আসছে। এ বছর ৪০টি চারা কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করেছি। ওই সব চারাতেও ফলন এসেছি। আমি মেবাইলে তাদের সার্বিক পরামর্শ দিয়ে থাকি। তারা আমাকে জানায় যে আমার দেওয়া চারাতে ফলন এসেছে এবং ফল খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু। তখন আমার নিজেকে অনেক সফল মনে হয়। আমি এই আঙুর চাষ করতে এসে অনেক ঠকেছি।মানুষকে বিশ্বাস করে তাদের থেকে চারা নিয়ে লাগিয়ে দেখি ফল টক। কিন্তু আমি মানুষকে ঠকাব না।

তিনি আরও বলেন, আমি কখনো আমার আঙুর গাছে ওষুধ কিংবা কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করিনি। বিষমুক্ত ফল মানুষের কাছে পৌঁছে দেব এটাই আমার ইচ্ছা। বাংলাদেশের মাটি আঙুর চাষের উপযোগী। তাই সবাই তার বাড়ির আঙিনায় আঙুর চাষ করুক যাতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে এটা আমদানি করতে না হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে, নিজ দেশের আঙুর চাষের মাধ্যমে পুষ্টি চাহিদাও মিটবে। যে কোনো মাটিতে ৫০ শতাংশ জৈব সার দিয়ে মাটি প্রস্তুত করে আঙুর ফল চাষ করা যায়। এটা লতা জাতীয় গাছ, অল্প খাবারে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। পরিচর্যা খুবই সহজ। একটি গাছ রোপণের পর প্রায় ৫০ বছর ফলন দেয়। প্রতি মৌসুমে একটি গাছে দেড় থেকে ২ মণ বা তারও বেশি ফলন হয়। একটি গাছে বছরে ৩ বার আঙুর ধরে।

সরোয়ার বিশ্বাসের বড় ভাই আজিজুর রহমান বিশ্বাস বলেন, আমার ছোট ভাই ইউটিউব দেখে মাল্টা ও কমলা চাষে সফল হবার পর এবার আঙুর ফল পরীক্ষামূলক চাষ করে সেখানেও সফল হয়েছে। এখন সে বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করবে। তার গাছে ধরা আঙুর বাজারের আঙুরের থেকেও বেশি মিষ্টি ও সুস্বাদু। প্রতিটি থোকায় ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম আঙুর ধরেছে। আমার ছোট ভাইয়ের আঙুর ফলের বাগান দেখতে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা এসে ভিড় করে।

সরোয়ারের বন্ধু কাজী জাহাঙ্গীর ও প্রতিবেশী হোসেন বলেন, আমরা জানতাম আঙুর বিদেশি ফল। কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতেই আঙুর চাষ হচ্ছে। এই আঙুরটি বাজারের আঙুর থেকেও বেশি মিষ্টি। বিভিন্ন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে দেখছে, আঙুর ফল খেয়ে সুনাম করছে। আমরাও সরোয়ারের দেখাদেখি আঙুর ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।

রাজবাড়ী সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জনি খান বলেন, চর বাগমরা গ্রামের সরোয়ার বিশ্বাস পরীক্ষামূলকভাবে তার বাড়ির আঙিনায় আঙুর চাষ করেছে। সব দিক বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে রাজবাড়ীর মাটি ও আবহাওয়া আঙুর চাষের জন্য উপযুক্ত। সরোয়ারের উৎপাদিত আঙুর স্বাদে খুব মিষ্টি। এলাকার লোকজন তার বাগান দেখে উৎসাহিত হচ্ছে। আশা করছি সরোয়ারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আশপাশের যারা বেকার যুবক রয়েছেন তারা আঙুর চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *