ঈদেও বেতন নেই সাবিনা-রেফারিদের, স্টাফদের পকেটে বোনাস
কয়েক ঘণ্টা পরই সারাদেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। এমন আনন্দঘন মুহূর্তেও নারী ফুটবলারদের মনে খুশির ঝিলিক নেই। গত মার্চ মাস থেকেই তারা বেতন পাচ্ছেন না। এমনকি ঈদের আগেও তাদের বকেয়া পরিশোধ করেনি বাফুফে। শুধু মাসিক বেতনই নয়, দুই সপ্তাহ আগে হয়ে যাওয়া চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে দুই ম্যাচের ফি–ও পাননি নারী ফুটবলাররা।
জাতীয় দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ঈদ কাটাতে গেছেন নিজ জেলা সাতক্ষীরায়। সেখান থেকে বেশ হতাশামাখা কণ্ঠে জানান, ‘মেয়েরা আমাকে প্রতিনিয়ত এ নিয়ে কথা বলছে। আমি ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসার আগে ফেডারেশনকে বলেছিলাম দ্রুত দেওয়ার জন্য। এসেও মেসেজ দিয়েছি, কোনো রিপ্লাই পাইনি। ঈদের আগে এমন অবস্থা খুবই হতাশার।’ বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের অন্যতম সিনিয়র খেলোয়াড় মারিয়া মান্ডা। তিনি অমুসলিম হলেও সতীর্থদের প্রতি তার গভীর সমবেদনা, ‘ঈদ নিয়ে সবারই একটা পরিকল্পনা থাকে, আবার অনেকের পরিবার আমাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাদের জন্য বিষয়টি অনেক কষ্টের।’
সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সাবিনাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন-বিদ্রোহ করতে হয়েছে। অনেক সংগ্রাম ও চাপের পর মেয়েদের সঙ্গে আগস্ট মাসে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে বাফুফে। ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন চুক্তির দিন বলেছিলেন, ‘এখন থেকে সবকিছু পেশাদারভাবে হবে।’ সভাপতির মন্তব্য একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রথম চুক্তির ছয় মাসে প্রতিবারই বেতন বকেয়া রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে সেই ছয় মাস শেষ মাস শেষ হওয়ার পর চুক্তি নবায়নের সময় সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার বলেছিলেন, ‘মেয়েরা এখন ফিফা ফান্ডের আওতায় আসছে, আর বিলম্ব হবে না।’ অথচ নতুন চুক্তিতে আরও বিড়ম্বনা বেড়েছে। তিন মাস পেরিয়ে গেলেও ফিফার ফান্ড থেকে মেয়েদের বেতনের বিষয়টি বাফুফে এখনও অনুমোদন পায়নি। তাই মেয়েদের বেতন দিতে পারছে না বাফুফে।
এ নিয়ে সাধারণ সম্পাদক বলছেন, ‘আমরা মেয়েদের গ্রেডিংয়ের মাধ্যমে বেতন নির্ধারণ করেছি, ফিফা সেটা মূল্যায়ন করছে। ফিফা এখনও তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি। ফিফার অনুমতি ছাড়া ফান্ডের অর্থ প্রদান করা যাবে না। আমরা শুক্রবারও ফিফার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমাদের ব্যাংকে নির্দেশনা ছিল, ফিফার সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নারী ফুটবলারদের অর্থ তাদের অ্যাকাউন্টে চলে যেত।’
বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ। তিনি ফিফার সাবেক নির্বাহী সদস্য ও এএফসির নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচরণ করা একজন কর্মকর্তা থাকতে সাবিনাদের বিষয়টি এসপার-ওসপার হতে তিন মাসের অপেক্ষা অত্যন্ত হতাশাজনক। বাফুফের নিজস্ব তহবিল সংকট ও তহবিলের অর্থ খরচে ফিফা-এএফসির নানা নির্দেশনা থাকে। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদসহ আরও অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে বেশ বিত্তবান।
মেয়েদের এক মাসের বেতন সর্বসাকুল্যে ১২-১৫ লাখ টাকা। ঈদের আগে অন্তত এক মাসের এই অর্থ বাফুফের অনেক কর্মকর্তা একাই দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন। সামর্থ্য থাকলেও মানসিকতার নিদর্শন রাখা অবশ্য কঠিন। সেই কঠিন নজিরই স্থাপন করেছেন তারা। ঈদের আগে কেউ নারী ফুটবলারদের সংকটে পাশে দাঁড়াননি। নিজেরা অপেশাদার ও অমানবিক আচরণ করলেও, এক বছরের বেশি সময় ইনজুরিতে ভুগে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ায় কৃষ্ণা রাণী সরকারকে শোকজের হুঙ্কার ঠিকই দিয়েছিলেন নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান। পরে অবশ্য মিডিয়া ও ফুটবলপ্রেমীদের সমালোচনায় সেই পথে হাঁটার সাহস পায়নি বাফুফে।
সাবিনাদের মতোই অবস্থা রেফারিদেরও। ফেডারেশনের কাছে তাদের বকেয়া কোটি টাকারও ওপরে। ঈদের আগে শুধুমাত্র তাদের চলমান লিগের ত্রিশ লাখ টাকার মতো পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটাও একেবারে অন্তিম মুহূর্তে। বৃহস্পতিবার শেষ ব্যাংকিং দিবসের একেবারে শেষ মুহূর্তে বাফুফে রেফারিদের বিল পরিশোধের জন্য ব্যাংকে পাঠায়। এখন পর্যন্ত রেফারিরা টাকা পাননি। আগামীকাল ঈদ, ফলে তার আগে বেতন পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যদিও ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দাবি, ‘শনিবার (গতকাল) প্রিমিয়ার ব্যাংক আমাদের নিশ্চিত করেছে রেফারিদের টাকা ট্রান্সফার করেছে।’
ঈদের আগে রেফারিদের সম্মানি নিয়ে এমন ঘটনা নতুন নয়। তাই কিছু রেফারি উদ্ভুত ঘটনাকে ইঁদুর-বিড়াল খেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাফুফের সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী ফিন্যান্স কমিটির পাশাপাশি রেফারি কমিটিরও চেয়ারম্যান। রেফারিদের বিল বকেয়া ও বিলম্বের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এএফসি ও ফিফার অর্থ নির্দিষ্ট খাতের বাইরে খরচ করা যায় না। আমাদের অনেক টুর্নামেন্ট ও খেলা চলে, সংশ্লিষ্ট খেলায় রেফারিদের জন্য আলাদা বাজেট থাকে না, একটা ঘাটতি তৈরি হয়। আবার আমাদের স্পন্সরও নেই, ফলে রেফারিদের বিল দিতে বিলম্ব হয়।’
বাফুফের চেকে স্বাক্ষর করার এখতিয়ার সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী ও সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদের। তিনজনের যেকোনো দুইজনের স্বাক্ষরে টাকা উত্তোলন করা যায়। অধিকাংশ চেকে নাবিল ও সালাম স্বাক্ষর করেন। দুইজনই এমপি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হওয়ায় তাদের স্বাক্ষর নিতে অনেক সময় ২ দিনও লেগে যায়। ফলে বিল প্রদান বা ক্রয়ে বিলম্ব দেখা দেয়।
সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসের অন্তিম সময়ে রেফারিদের বিল পরিশোধের নির্দেশনা ব্যাংকে পাঠায়। এত বিলম্বে বিল প্রেরণ নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। বাফুফে সাধারণ সম্পাদকের দেওয়া তথ্য বলছে, রেফারিদের বিল জমা পড়েছে বিলম্বে। তবে সাধারণ সম্পাদকের এই মন্তব্যে রেফারিরা ক্ষুব্ধ রেফারিজ বিভাগের ওপর। তাদের ক্ষোভ– যারা মাঠে খেলা চালায় ঈদের আগে তারা টাকা পাচ্ছে না, রেফারিজ বিভাগের দুই স্টাফ ঠিকই বেতন-বোনাস পেয়েছে। অথচ যাদের কাজ ছিল সঠিক সময়ে বিল তৈরি ও ফেডারেশনে জমা দেওয়া।
ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির অনেক কর্মকর্তার দৃষ্টিতে– ফেডারেশনে যেন শুধু স্টাফদের বেতন-বোনাস দিয়ে পালার জন্যই। ফুটবলার-রেফারিরা ঈদের আগে ন্যূনতম সম্মানী না পেলেও, স্টাফরা বেতন-বোনাস একসঙ্গে হাতে পেয়েছেন গত ২৮ মে। স্টাফরা ইতোমধ্যে কোরবানির প্রস্তুতি ও অনেক আয়েশে ঈদের ছুটি কাটালেও নারী ফুটবলার ও রেফারিদের ঈদ কষ্টের। এই বিষয়ে স্টাফদের পক্ষই নিলেন সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী, ‘ফুটবল ফেডারেশনের আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ফিফা ও এএফসির অনুদান। তাদের অর্থ প্রশাসনিক খাতে ব্যয় করার নির্দেশনা রয়েছে। প্রশাসনিক খাতে ফান্ড আছে, তাই স্টাফরা নিয়মিত বেতন-বোনাস পায়।’
ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির অনেকে অবশ্য এর সঙ্গে একমত নন। তাদের কারো মতে– নারী ফুটবলারদের বেতন প্রদান, ক্লাবগুলোর অংশগ্রহণ ফি, প্রাইজমানি প্রদানে ফিফার অনুমোদন পাওয়া যায় না। অথচ প্রতি মাসেই এক্সিকিউটিভ নিয়োগ ও তাদের আকাশচুম্বী প্রদানের ক্ষেত্রে ফিফার নির্দেশনা নেই, বিষয়টি বেমানান।
ফুটবল ফেডারেশনে বেতনভুক্ত স্টাফদের আধিক্য ও প্রাধান্য দুটোই রয়েছে। রেফারি-ফুটবলারদের বেতন প্রদানে কার্পণ্য ও বিলম্ব থাকলেও স্টাফদের আয়েশে একেবারে উদার মনোভাব। ফেডারেশনে সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সহ-সভাপতিদের স্ব স্ব কক্ষ রয়েছে। ১৫ নির্বাহী সদস্যের জন্য কোনো কক্ষ নেই (শুধু নারী ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান কিরণের রয়েছে)। অথচ এক্সিকিউটিভদের জন্য রয়েছে বড় কক্ষ। ফিন্যান্স ও প্রকিউরমেন্ট বিভাগের রুম ডেকোরেশনে সম্প্রতি কয়েক লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। অথচ এই দুই বিভাগের জন্যই বাফুফে ফিফার শাস্তি–নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে।
ফিফা রিপোর্টে যাদের নাম এসেছে, তাদের পকেটেই আগে বেতন জমা হয়। যাদের স্বাক্ষরে তাদের বেতন হয় সেই কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে রিপোর্টে। কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে থাকলে স্টাফরা তো রাজত্ব করবেই! আর দেশের মানুষের প্রাণের খেলা ফুটবল নীরবে-নিভৃতে কাঁদে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৮৪ নম্বরে থেকে।