চট্টগ্রাম

এক চাকরিতে সংসার চলছে না মধ্যবিত্তের

নগরে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩য় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন ইমতিয়াজ মাসুদ। ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে বর্তমানে বাস করছেন নগরীর জামালখান এলাকায়। গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবা-মায়ের ভরণপোষণের ব্যয়ও বহন করেন তিনি।

দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে এই চাকরির উপার্জন দিয়ে সংসার চলছিল না তার। প্রতিমাসেই ঋণ করতে হতো ৩-৫ হাজার টাকা। তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি আয়ের চিন্তা করেন। অফিসের বাইরে পার্টটাইম চাকরি হিসেবে একটি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে ডাটা এন্ট্রির কাজ শুরু করেন। দুই চাকরির আয় দিয়েও সংসার চালাতে হিমশিম খান ইমতিয়াজ। তাই দুই চাকরি ফাঁকে যেটুকু সময় পান, সেই সময়টুকুতে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করে বাড়তি উপার্জনের চেষ্টা করেন।

ইমতিয়াজ জানান, দুই চাকরির পাশাপাশি মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করেও সচ্ছলভাবে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। দক্ষতার জোরে চাকরি পাওয়াটা তার জন্য খুব বেশি কঠিন না হলেও অন্যদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। চাইলেই মিলছে না চাকরি। মিললেও কর্মঘণ্টার তুলনায় পারিশ্রমিক নগণ্য। তা আবার এখনকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে পরিবার নিয়ে ১০ দিন চলতে পারার মতোও না।

শুধু ইমতিয়াজ নন, দেশের অধিকাংশ মানুষের বর্তমান পরিস্থিতিই এমন। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রতিমাসেই ঋণ করতে হচ্ছে নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের। নগরীর অক্সিজেন এলাকার বাসিন্দা দেবু বড়–য়া বলেন, একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করে আমি প্রতিমাসে ১৯ হাজার টাকা বেতন পাই। কিন্তু এই টাকা দিয়ে আমাদের ৬ সদস্যের পরিবার চালানো সম্ভব হচ্ছে না এখন। প্রতিমাসের শেষ দিকে অন্তত চার হাজার টাকা ঋণ করতে হয়। তাই এখন পার্টটাইম একটা চাকরি খুঁজছি।

দ্রব্যমূল্যের ‘পাগলা ঘোড়া’র লাগামহীন ছুটের বিষয়ে ইমতিয়াজ ও দেবু বড়–য়ার কথার সত্যতা মিলেছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর পর্যালোচনায়। এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, হলুদ, মরিচ, লবণ, আলু, আটার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারদর বেড়েছে ২৭ থেকে সোয়া ২০০ শতাংশ পর্যন্ত।

২০১৯ সালের ২৫ মে গরিবের চাল খ্যাত সবচেয়ে নি¤œমানের মোটা চালের দাম ছিল ৩৪ টাকা। গেলো ৫ বছরে প্রায় ৪৭ শতাংশ বেড়ে সেই চালের দাম এখন ৫০ টাকা। একইভাবে গেলো ৫ বছরে কেজিতে ৩০ ও ৬০ শতাংশ করে বেড়েছে দেশি মসুর ডাল ও লবণের দাম। পাঁচ বছর আগের ১০০ টাকা লিটারের সয়াবিন তেল কেনার জন্য এখন গুনতে হচ্ছে ১৬০-১৬৫ টাকা।

এখনকার বাজারে ৬৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া দেশি পেঁয়াজ ২০১৯ সালের ২৫ মে বিক্রি হয়েছিল ২২ টাকায়, পাঁচ বছরে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৯৬ শতাংশের বেশি। একইভাবে হলুদের মূল্য ৬৬.৬৭ শতাংশ, মরিচের মূল্য ৭৭.৭৮ শতাংশ, আলুর মূল্য ২৩৩.৩৩ শতাংশ বেড়েছে। মাছ-মাংসের মধ্যে কেজিতে ব্রয়লার মুরগির দাম ৪৪.৪৪ শতাংশ, গরুর মাংসের দাম ৪২.৮৬ শতাংশ এবং মাঝারি আকারের রুই মাছের মূল্য ২৭.২৭ শতাংশ বেড়েছে।

গেলো পাঁচ বছরে দ্রব্যমূল্যের এমন বৃদ্ধিতে বাড়তি আয়ের চিন্তায় নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় ফেরি করে চা বিক্রি শুরু করেছেন টেকনিক্যাল এলাকার জুতার কারখানার কর্মচারী তোতা মিয়া। তিনি বলেন, সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কারখানায় কাজ করতে হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে এখন আর পরিবার চালানো যায় না। তাই রাতে বাসায় ফেরার পরপরই চা বিক্রি করতে বের হই। প্রতিদিন রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিপ্লব উদ্যানে ফেরি করে চা বিক্রি করি।

এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, আগে মানুষ ঋণ করা, সঞ্চয় ভাঙাসহ নানাভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করলেও এখন আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। খন্ডকালীন চাকরিও জুটছে না সহজে। সবমিলিয়ে কঠিন বাস্তবতায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা।

সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, করোনার সময় সীমিত আয়ের মানুষের স্যালারি কাটছাঁট করা হয়েছিল। ওই পরিস্থিতি পার হওয়ার পরও অনেকের আয় কিন্তু বাড়েনি। উল্টো ভোগ্যপণ্যের লাগাতার দাম বৃদ্ধির কারণে জীবন-জীবিকার খরচ বেড়ে গেছে, এই বৃদ্ধির পাল্লাটাও অনেক বেশি। তিনি বলেন, শুরুর দিকে কেউ ঋণ করে, কেউ সঞ্চয় ভেঙে, কেউ পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। এখন আর সেই পরিস্থিতিও নেই। আয় তো বাড়ছেই না, মূল্যবৃদ্ধি কিন্তু থামছে না। তাই মানুষ এখন খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করে ব্যয় সংকোচনের চেষ্টা করছে, মাছ-মাংস বা আমিষ বাদ দিচ্ছে। আবার অনেকেই খন্ডকালীন চাকরি খুঁজছেন। চাকরিও জুটছে না, কারণ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাও দুরাবস্থায়। তাই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি নিম্নআয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *