এবার সেই বিএনপি নেতার গাড়ির আবদার!
ভবিষ্যতে কোনো মামলায় আসামি না করার ‘গ্যারান্টি’ দেওয়া সেই বিএনপি নেতা এবার গাড়ির আবদার রেখেছেন আলোচিত-সমালোচিত শ্রমিক লীগ নেতা সামশুল ইসলামের কাছে! ওই শ্রমিক লীগ নেতাকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে শোনা গেছে মুহাম্মদ জিয়াউল হক জিয়া নামে এক সৌদিপ্রবাসীর সঙ্গে। সিভয়েস২৪’র হাতে তাদের দুজনের কথোপকথনের ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডের একটি অডিও এসেছে। সেখানেই শোনা গেছে পটিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব খোরশেদ আলমের গাড়িবিলাসের কথা। শুধু তাই নয়, তেলের ব্যবসার ভাগ চাওয়ার কথাও উঠে এসেছে অডিওতে। তবে বিএনপি নেতা খোরশেদের দাবি, তাকে নিয়ে গুজব রটানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন।
এর আগে বিএনপি নেতা খোরশেদ আলমের সঙ্গে পটিয়া উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি সামশুল ইসলামের কথোপকথনের একটি অডিও আসে সিভয়েস২৪’এর হাতে। ওই অডিওতে তাঁকে ভবিষ্যতে কোনো মামলার আসামি না করার ‘গ্যারান্টি’ দিয়েছিলেন খোরশেদ।
সৌদি প্রবাসী মুহাম্মদ জিয়াউল হক জিয়া পটিয়ার কোলাগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির সঙ্গেও যুক্ত বলে জানা গেছে।
রেকর্ডটিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তারা (সামশুল-জিয়া) কথা বলছিলেন। শুরুতে তাদের মধ্যে সালাম বিনিময় হয়। এরপর সৌদিপ্রবাসী জিয়াউল হক জানতে চান সামশুল ইসলামের কাছে— ‘ফেসবুকজুড়ে এতো লেখালেখি কেন হচ্ছে?’
তখন সামশুল ইসলাম বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহসহ ৩০ জন ছাত্র চট্টগ্রামে দুদিনের সফরে আসে। ওই সময় রাতে ১২টার দিকে আমার বাসায় ভাত খেতে এসে সেখানেই থেকে (রাত্রিযাপন) গেছে। পরে ফজরের সময় নাস্তা করে সমন্বয়করা খাগড়াছড়ি চলে যায়। তাদের সঙ্গে দু’একটা ছবি তুলেছি। কিন্তু ছবিগুলো তোলায় ভুল হয়েছে। এগুলো তোলা উচিত ছিল না। আমাদের ইমাম সাহেব একজন ছবি তুলতে বলছে; আমিও তুলে ফেলেছি। এখন ওই ইমাম সাহেব ছবিটা প্রথমেই ছেড়ে দিয়েছে। এরপর এখানের আরো অনেকে সেটা ছেড়ে দিয়েছে ফেসবুকে। এগুলো আমি ছাড়ি নাই। এখন এসব ছবি নিয়ে সবাই ট্রল করছে। আওয়ামী লীগের নেতার বাড়িতে এই…সেই।’
এ সময় জিয়া জানতে চান খোরশেদ আলমের সঙ্গে সামশুলের ভেজাল চলছে কিনা— প্রতিউত্তরে সামশুল বলেন, ‘বড় ধরনের ভেজাল বাজাতে চাচ্ছে। খোরশেদ এখন আমার কাছ থেকে একটা গাড়ি চাচ্ছে। প্রথমে চেয়েছিল তেলের ব্যবসা। ফ্যাক্টরিতে যেতে চাইছে। নম্বর দিতে বলেছিল। হারুন চৌধুরীকে দিয়ে ফোনও করিয়েছে।’
তবে ‘হারুন চৌধুরী ভেতরে আছে ওপেনে নেই’ বলে জানিয়েছেন। বলেন, ‘শফিক চেয়ারম্যানসহ আমাকে ডাকছে ব্যবসা নেওয়ার জন্য। এর আগে, আরেকটি জুন্নুদের গ্রুপ যেটা আছে..সেটা আবার এনাম সাহেব ডেকেছে। এনাম সাহেবও ব্যবসায় এগুলোতে মাথা ঘামাচ্ছে, তারাও মাথা ঘামাচ্ছে। মানে গ্রুপ দু’টি হয়ে গেছে।’
তাদের বলছি— ‘আমি কোন দিকে যাব। তোমরা সবাই আমাকে নিয়ে টানাটানি করলে। এদিকে আবার নেছার মিয়াও ডাকছে। নেছার মিয়াকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর তিনি বুঝেছেন। তিনি বলছেন, এগুলো পঁচা ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।’
বেচে যাওয়া জিনিসপত্র বেচাবিক্রিতে যা লাভ হয় তার সব খোরশেদকে দিয়ে দিতে বলা হয়েছে জানিয়ে সামশুল বলেন, ‘খোরশেদ মিয়া আমাকে প্রস্তাব দিছে যে, যা মাল জমা হয়েছে; সাত-আট মাস মোতাহেরুলের মানুষের জন্য ব্যবসা করতে পারিনি। তা বেচাবিক্রি করে যা লাভ হয় তার পুরোটাই তাকে (খোরশেদ) দিয়ে দিতে। সে একটা গাড়ি নিবে। তখন আমি বললাম, আমার কাজকাম নেই। তাই উনার যদি বেশি দরকার হয় আমার গাড়িটা ব্যবহার করতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি এতে রাজি হননি।’
‘তখন খোরশেদকে আমি বলি— এটা দিতে পারবো না। এনাম সাহেব ডাকছে, আপনিও (খোরশেদ) ডাকছেন; আমি কি করবো। তাই এনাম সাহেবের সঙ্গে আপনি কথা বলেন, শাহনেওয়াজ তো এসব ডিল করে। জুনিয়র কিছু ছেলে আছে এগুলো বাদ দিতে পারবেন না। এগুলোকে না দিয়ে বা বাদ দিয়ে যদি একা কিছু করতে চান; তাহলে ইজ্জত সম্মান যা আছে তা আর থাকবে না। পরে কোনো রকমে এসব বুঝায়।’
‘পরে সেখানে এনাম সাহেব একটা সিস্টেম করে দিয়েছে যে, তিন ভাগ করবে। এর মধ্যে এক ভাগ আমার কাছে থাকবে শাহনেওয়াজকে নিয়ে, আরেকভাগ বদি বদ্দার কাছে থাকবে অর্থাৎ জুনিয়র ছেলে যেগুলো আছে এলাকার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ছেলে আছে তারা এক ভাগ, আর বাকি একভাগ সিনিয়ররা পাবে’।
‘প্রায় ২৩ গাড়ি মালগুলো বিক্রি করার পরে ৬ লাখ ৫৪ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। একভাগে ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা করে পড়ে। এক ভাগের টাকা কেউ ছেড়ে দিলেই তো খোরশেদকে দেওয়া যাবে। কিন্তু খোরশেদ উল্টে গেছে। এগুলো বাদ দিয়ে মানে ব্যবসা বাদ দিয়ে আমার কাছ থেকে দিতাম। না হলে মামলা দিবে। আরো দুই-চার-দশটা মামলা হবে। যে সেখানে দিবে এর মধ্যে অলরেডি একটিতে দিছে।’
আগে প্রতারণা করে টাকা খেয়ে ফেলার কথা জানিয়ে সামশুল বলেন, ‘গ্রাহকের মিটারের জন্য দেওয়া ৪০ হাজার টাকাও খেয়ে ফেলেছিল খোরশেদ। পরে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে তা আমি যাদের টাকা তাদের ফেরত দিয়েছি। সে কি কম জ্বালানো জ্বালাইছে আমাকে।’
তখন জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা যখন একসঙ্গে চলাফেরা করেছি তখন অপবিত্র ছিল না। …আমি কখনো আপনার কাছ থেকে টাকা খুঁজি নাই। একসময় শাহনেওয়াজ আমাকে ব্যবসার লোভ লাগাইছিল। আমি যাইনি, শাহনেওয়াজের কথাকে গুরুত্ব দি নাই; আপনার কথা শুনেছি। আপনি আওয়ামী লীগেও মন থেকে যাননি। কারে কেমন করছে বা চক্র তা তো আমি জানি।’
জিয়াউল আরো বলেন, ‘আপনাকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করাটা খোরশেদের.. সব তথ্য আমার কাছে আছে। আমরা মানুষকে বেশি হেয় করছি না, বেইজ্জতও করছি না। এগুলো ভালো না। আপনি সম্মান করলে, আপনার সম্মান আল্লাহ দিবেন। খোরশেদের ব্যাপারে আমার কাছে যে তথ্য আছে; শুধু তা সত্য কিনা সেজন্য আপনাকে কল দিয়েছি।’
এ বিষয়ে পটিয়া উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি সামশুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জিয়ার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি অস্বীকার করে সরাসরি সাক্ষাতে কথা বলার অনুরোধ জানান।
এদিকে গাড়ির আবদার রাখা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুরোটা মিথ্যা এবং গুজব রটানো হচ্ছে বলে দাবি করেছেন পটিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, ‘না এমনটা তো হতে পারে না। উনার (সামশুল) সঙ্গে আমি শুধু একবার ফোনে কথা বলেছিলাম। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। এছাড়া উনার সঙ্গে কোথাও বসে তো এক কাপ চাও খাইনি! এভাবে যদি মিথ্যা রটানো হয় তাহলে আমাকে আইনি ব্যবস্থা নিতেই হবে।‘
এর আগে ২০ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের সময় পটিয়া উপজেলা বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর, ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলিবর্ষণের অভিযোগে করা একটি মামলায় আসামি হন উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি সামশুল ইসলাম। ওই মামলায় ৩৩ নম্বর আসামি তিনি।
মামলা-পরবর্তীতে শ্রমিক লীগ নেতা সামশুল ইসলাম এবং উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব খোরশেদ আলমের মুঠোফোনে কথোপকথনের ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ডের একটি অডিও রেকর্ড সিভয়েস২৪’এর হাতে আসে। ওই কথোপকথনে উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব খোরশেদ আলম মামলায় শীর্ষস্থানীয় ওই শ্রমিক লীগ নেতার নাম থাকাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাবি করেছেন। একইসাথে ওই নেতাকে গ্রেপ্তার এবং ভবিষ্যতে কোনো মামলায় ‘আসামি না করার’ গ্যারান্টিও দিয়েছেন তিনি!
প্রসঙ্গত, গত ৮ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বড় একটি বহর নিয়ে পটিয়ার কোলাগাঁও ইউনিয়নে উপজেলা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি সামশুল ইসলামের গ্রামের বাড়িতে যান। সেখানে রাতযাপন করে ৯ সেপ্টেম্বর সকালে তিনি খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সামশুল আলমের বড় ছেলে হাবিবুল ইসলাম সাকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসনাত আবদুল্লাহর সহপাঠী বলে জানা গেছে।