ওরা সরকারি জায়গা ইজারা দেয়, দোকান থেকেও টাকা নেয়
সরকারি জায়গা ইজারা দিচ্ছেন নেতা। হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। আর ইজারা দেওয়া জায়গায় গড়ে ওঠা দোকান থেকেও প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। নগরীর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে দখলদারিত্ব এবং চাঁদাবাজি নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই গ্রুপের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন দোকান। এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকে ঘিরে প্রতিদিন সংঘর্ষ, মারামারি এবং হাতাহাতির ঘটনাও ঘটছে।
এর ফলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন পর্যটকরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরস্পরের প্রতি বাক্যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করছে। সৈকত ঘিরে বড় ধরনের সংঘর্ষেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পতেঙ্গা সৈকতের দখলদারিত্বকে কেন্দ্র করে পতেঙ্গা এবং সন্নিহিত অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এখানে দোকানঘর নির্মাণ এবং ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনার পাশাপাশি দোকানঘর থেকে দৈনিক লাখ লাখ টাকা চাঁদা ওঠানোকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন মারামারির ঘটনা ঘটছে। সৈকতসহ বিস্তৃত কয়েক কিলোমিটার সরকারি জায়গা স্থানীয় নেতারা ইজারা দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। একটি দোকানের জায়গা দেওয়ার জন্য ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। ওই দোকানে ব্যবসা করতে প্রতিদিন দোকান ভেদে সর্বনিম্ন ১শ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৭শ টাকা পর্যন্ত চাঁদা পরিশোধ করতে হয়। দৈনিক এই টাকা সন্ধ্যার সময় নেতার লোকজন এসে নিয়ে যায়।
জানা যায়, ওয়াহিদুল আলম ও মুছা আলমের নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে পতেঙ্গা সৈকতের পুরো এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করত। এই গ্রুপটি এলাকায় দোকান গড়ে তোলা থেকে ব্যবসা পরিচালনা পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে চাঁদা আদায় করে আসছিল। প্রতিপক্ষ গ্রুপ না থাকায় অঘটনের শঙ্কা ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মাসুদ আলম নামে এক সন্ত্রাসী ওয়াহিদুল আলম ও মুছা আলমের গ্রুপকে কোণঠাসা করে সৈকতসহ সন্নিহিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন।
মাসুদের গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সরকারি জমি লিজ দেওয়ার কার্যক্রম বেড়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন দোকান গড়ে উঠছে সৈকতে। গতকাল আনুমানিক হিসাব করে দেখা গেছে, সৈকতে ইতোমধ্যে ৫শর বেশি দোকান গড়ে তুলে পুরো এলাকাটিকে ঘিঞ্জি করে ফেলা হয়েছে।
পতেঙ্গা সৈকত থেকে দৈনিক যে চাঁদা আদায় করা হয় পুলিশের কাছে তার তথ্য এসেছে। পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বিচের প্রতিটি খাবারের দোকানে শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতিদিন ১০০ টাকা এবং শুক্রবার ২০০ টাকা, মালাই চায়ের দোকান থেকে প্রতি কাপ চায়ে ১০ টাকা, নাগরদোলার আয় থেকে ৪০ শতাংশ, বাদাম, ঝালমুড়িসহ ভাসমান হকারদের কাছ থেকে ১০০ টাকা, চাঁদার বাইরে বিদ্যুৎ বিলের নামে প্রতিদিন প্রতি লাইটের জন্য ৩০ টাকা করে আদায় করা হয়।
দোকানপ্রতি গড়ে ৫শ টাকা দৈনিক চাঁদা তোলা হলে প্রতিদিন চাঁদা উঠছে আড়াই লাখ টাকা। প্রতি মাসে যা দাঁড়ায় ৭৫ লাখ টাকায়। দোকান ইজারা খাতে আয় অনেক বেশি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
প্রতিদিন মারামারির ঘটনা নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয় ব্যবসায়ী কবির আহমেদ। তিনি বলেন, টাকা দিয়ে ব্যবসা করি। লাভের টাকা ওরা নিয়ে যায়। আমাদের কোনো রকমে দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতো চলছে। তিনি বলেন, পেঁয়াজু এবং মাছ ভাজা বিক্রি করি। দৈনিক ৫শ টাকা চাঁদা দিতে হয়। কত টাকা ব্যবসা করলে ৫শ টাকা লাভ হয়? দোকানের স্টাফ খরচ, জিনিসপত্রের দাম কোথায়? আমি খাব কি? তিনি বলেন, এখানে যে অবস্থা শুরু হয়েছে, খারাপ কিছু ঘটবে।
নাম প্রকাশ না করে আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, পতেঙ্গা সৈকতে এখন আর আগের শান্তি নেই। সৈকত সুন্দর হয়েছে, মানুষের সুবিধা হয়েছে। কিন্তু অশান্তি বেড়ে গেছে। প্রতিদিন মারামারি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এক পক্ষ চাঁদা নিয়ে যাওয়ার পর অপর পক্ষ চড়াও হয় মাঝেমধ্যে। কী যে যন্ত্রণার মধ্যে আছি! পর্যটক কমে গেছে উল্লেখ করে আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, যেভাবে মারামারি, হাতাহাতি এবং হয়রানির ঘটনা ঘটে, তাতে বিচে পর্যটক কমে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরস্পরের প্রতি লেখালেখি এবং উস্কানিমূলক নানা পোস্ট উত্তেজনা বাড়াচ্ছে মন্তব্য করে পতেঙ্গা থানার একজন কর্মকর্তা জানান, বিচে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য ওয়াহিদ মাস্টার গ্রুপ এবং মাসুদ আলম গ্রুপ নিজেদের মধ্যে হানাহানি করছে। এর মধ্যে বেশ কিছু নারীও যুক্ত হয়েছে।
পতেঙ্গা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কবিরুল ইসলাম বলেন, পতেঙ্গা সৈকত নিয়ে একাধিক সিন্ডিকেট তৎপর। এখানে অশান্তি চলছে। সৈকতের দোকানগুলো অবৈধ। এগুলো নিয়ে অবৈধ নানা তৎপরতা রয়েছে। হকার সমিতি, ক্যামেরাম্যান সমিতিসহ নানা নামে, নানাভাবে সংগঠিত হয়ে তারা অপকর্ম করার চেষ্টা করে। পুলিশ নানাভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখছে। আমরা বিষয়টির উপর কড়া নজর রাখছি।