অর্থনীতিজাতীয়

কমছে ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোরালো পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের

দেশে চলমান ডলার সংকট কেটে যাচ্ছে। শক্তিশালী হতে যাচ্ছে টাকা। এরই মধ্যে দুই দফায় ৭৫ পয়সা কমানো হয়েছে ডলারের দর। একই সঙ্গে সরবরাহ ক্রমাগত বৃদ্ধি ও দাম আরও কমে আসার আভাসও মিলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলার জমা রাখার হার বেড়েছে, কমেছে বাণিজ্য ঘাটতি। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক দায় শোধের চাপও কিছুটা কমে এসেছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসায় রিজার্ভের ওপর চাপও কমে এসেছে।

এদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বা রেপো রেট এক লাফে ০.৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ-আমানতের সুদহারের সীমা তুলে দিয়েছে তারা। একই সঙ্গে দেশে ডলার সংকট কাটাতে ব্যাংক আমানতে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ মুনাফা ঘোষণা করা হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এর পর থেকে এই দুই সংগঠন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে।

প্রথম দফায় গত ২২ নভেম্বর রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমানো হয়। এরপর গত বুধবার রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ২৫ পয়সা কমিয়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে রেমিটেন্স ও রপ্তানিতে প্রতি ডলারে পাবেন ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। আর আমদানিকারদের কাছে বিক্রি করা হবে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। নির্ধারিত দামের সঙ্গে ব্যাংকগুলো রেমিটেন্সে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেবে। তবে কোনো ব্যাংক চাইলে এর সঙ্গে অতিরিক্ত আরও আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করতে পারবে।
এদিকে ঋণাত্মক অবস্থা থেকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স বা চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও এখন সেপ্টেম্বরের হিসাবে ১ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্তে ফিরে এসেছে। নানামুখী পদক্ষেপের কারণে আগামীতে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিবাচক অবস্থাতেই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্বস্তির খবর হচ্ছে, ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার প্রতিশ্রুত ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ ছাড় হতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুত ও পুঞ্জীভূত ঋণের অর্থ ছাড়ের গতি ও ধারাবাহিকতা বাড়তে থাকবে।

এ নিয়ে সরকার দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে অব্যাহতভাবে দেনদরবার করে যাচ্ছে। তদুপরি সরকারও এ মুহূর্তে বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোতেই বেশি জোর দিচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে গত চার মাসে নতুন করে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৪৬২ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের। একইভাবে এই সময় উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ১৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ। বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, আমাদের চলতি হিসাবে ঘাটতি কাটিয়ে এখন উদ্বৃত্ত হয়েছে। দেড় বছর আগেও প্রায় ১৮ বিলিয়ন ঘাটতি ছিল। বর্তমানে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। সেই হিসাবে বাজারে ডলারের সংকট থাকার কথা নয়। বর্তমানে ডলার বাজারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, সেটি প্রকৃত চিত্র নয়। তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে ডলারের দর বাড়ার যে প্রবণতা, সেটি থাকার কোনো কারণ নেই।
এদিকে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় ঋণের সুদহার আরও বাড়ানো হয়েছে। এবার নীতি সুদহার বা রেপো রেট এক লাফে ০.৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এখন নীতি সুদহার বা রেপো রেট হয়েছে ৭.৭৫ শতাংশ। এ ছাড়া নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএসএফ) সুদহার বিদ্যমান ৯.২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৯.৭৫ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে নীতি সুদহার করিডরের নি¤œসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার বিদ্যমান ৫.২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৫.৭৫ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে রাখা আমানত ও ব্যাংকঋণের সুদহারও বাড়বে। ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করতে ব্যাংকিং খাতে ঋণ ও আমানতের সুদ ব্যবধান (স্প্রেড) তুলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতদিন স্প্রেড ৪ শতাংশ ছিল। এখন থেকে এর কোনো সীমা থাকবে না। ফলে ব্যাংকগুলো চাইলে আমানতে সুদ কম দিতে পারবে। এতদিন যে নিয়ম ছিল সে অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক আমানতের ওপর যদি ৫ শতাংশ সুদহার দিত তা হলে ওই ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ নিতে পারত।

নতুন  নির্দেশনা অনুযায়ী এখন ঋণ-আমানতের সুদহারের ক্ষেত্রে কোনো সীমা থাকবে না। তিন শতাংশে আমানত নিয়েও ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার সুযোগ পাবে। অর্থাৎ আমানতের সুদহার যাই হোক ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ রেটের সঙ্গে নির্ধারিত মার্জিন যোগ করে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়, ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার লক্ষ্যে ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) এর সঙ্গে নির্ধারিত মার্জিন যোগ করে সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে। সুদহার নির্ধারণের নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঋণের বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারিত হওয়ায় সুদহারের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব হয়েছে।

ফলে তারল্য পরিস্থিতির বিবেচনায় ঋণের সুদহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমানতের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানত ও ঋণের সুদহারের সীমা নির্ধারণ করার প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম জানান, অসহনীয় মূল্যস্ফীতিসহ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে আজকের যে চক্রাকার সমস্যা তৈরি হয়েছে, তার প্রধানতম কারণ হচ্ছে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ঘাটতি। এতে ডলার দুর্লভ হয়ে উঠেছে এবং দাম বেড়েছে লাগামহীন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্রেতা-ভোক্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *