জাতীয়

কোন আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় বেনজীরের সম্পদের পাহাড়!

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ শিল্পপতি ছিলেন না, বংশ পরম্পরায় বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকও ছিলেন না। তবুও তার ও তার স্ত্রী-সন্তানের সম্পদ যেন উপচে পড়ছে। দেশ-বিদেশে তার সম্পদের পাহাড়ের খবরে সবার চোখ কপালে উঠছে। এ যেন রূপকথার আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় সব এক মুহুর্তে গড়ে উঠেছে! ঘুরে ফিরে সর্বত্র এই নিয়ে আলোচনা চলছে।

এখন পর্যন্ত যত সম্পদের তথ্য বের হয়ে এসেছে, তাতে হাজার বিঘার বেশি জমি কিনে তিনি হয়েছেন ‘ল্যান্ডলর্ড’।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন- এর আগে কোনো আইজিপি বা শীর্ষস্থানীয় কোনো আমলার এত সম্পদের নজির দেখা যায়নি। সবাই বলছেন- বেনজীরের এত সম্পত্তি নজিরবিহীন।

দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে- এ পর্যন্ত বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বান্দরবান, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, গাজীপুরসহ ঢাকার আশপাশে হাজার বিঘার বেশি জমির সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানীর গুলশানে পাওয়া গেছে আলিশান চারটি ফ্ল্যাট, যেগুলোর মোট আয়তন ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট, যার বর্তমান বাজারদর ২৫ কোটি টাকার কম নয়। পরিবারটির নামে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের কয়েক কোটি টাকা মূল্যমানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। এসব হিসাব থেকে বেনজীর আহমেদ বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নিয়েছেন বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

দুর্নীতিবিরোধী এই প্রতিষ্ঠানটির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে- সরিয়ে নেয়া এই টাকার পরিমাণ কয়েকশ কোটি হতে পারে। জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের প্লাম জুমেরা ও মেরিনা এলাকায় বেনজীরের নামে-বেনামে বেশ কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। যার মধ্যে জুমেরা এলাকার ৪০ তলা কনকর্ড টাওয়ারে অবস্থিত একটি অ্যাপার্টমেন্ট কয়েকদিনের মধ্যেই প্রায় ২৯ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন।

দুবাইয়ের মস্কো নামের একটি বহুতল হোটেলে বেনজীরের যৌথ বিনিয়োগের তথ্যও আছে। আর ঢাকার ভাটারা থানাধীন একটি অভিজাত আবাসিক এলাকায় বেনজীরের একটি সাত তলা ভবন ছিল, সেটাও সম্প্রতি বিক্রি করে দিয়েছেন। আর টাকা সরানো ও সম্পদ বিক্রি করা হয়েছে আদালতের আদেশে দুদক কর্তৃক বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধ করার আগে।

এদিকে, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ছাড়াও কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের কোনো সম্পদ আছে কিনা, সে তথ্য অনুসন্ধানের অনুরোধ জানিয়ে বিএফআইইউতে চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদকের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে এসব দেশের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে বিএফআইইউ।

জানা গেছে, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় বৈরাগীটোল গ্রামে জমি কিনে বেনজীর গড়ে তুলেছেন সাভানা ইকোরিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্ক। প্রায় এক হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই ইকো রিসোর্টের বিভিন্ন জায়গায় মাটি ভরাট করে বানানো হয়েছে কৃত্রিম পাহাড়। সাগরের কৃত্রিম ঢেউ খেলানো সুইমিং পুলও রয়েছে এখানে। আছে হাজারের বেশি ভিয়েতনামি নারকেলগাছসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। রয়েছে বিশাল আকৃতির কনসার্ট হল। এছাড়া বেশ কয়েকটি পুকুর ও দৃষ্টিনন্দন ঘাট, কৃত্রিম ঝরনা ও বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স কটেজ।

এছাড়া কম যান না বেনজীরের শাশুড়ি-শ্যালকও। বেনজীরের প্রভাব কাজে লাগিয়ে সম্পত্তি বাগিয়েছেন শ্বশুরালয়ের আত্মীয়রাও। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দক্ষিণ আলীপুর গ্রামে ৪৮ বিঘা জমির ওপর একটি আধুনিক ইটভাটা স্থাপন করেছিলেন আনারুল ইসলামের ছেলে আশরাফুজ্জামান হাবলু। কিন্তু পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ইটভাটাটি যাত্রা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই দখল করে নেন বেনজীর আহমেদের শ্যালক মির্জা আনোয়ার পারভেজ। ভগ্নিপতির ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে হাবলুর কাছ থেকে ইটভাটাটি দখল করেন পারভেজ। এছাড়া সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার ১ নম্বর শোভনালী ইউনিয়নের শরাফপুর গ্রামে বেনজীরের শাশুড়ি লুৎফুন নেসার নামে শতাধিক বিঘার ওপর চারটি মাছের ঘের আছে বলে জানা গেছে। পাশাপাশি আরকুনি মৌজায় দুটি, পশ্চিম বিল আর পাশের পুঁটিমারি বিলেও আরো কয়েকটি মাছের ঘের রয়েছে।

মাদারীপুরে বেনজীরের স্ত্রীর বিপুল জমি : মাদারীপুরে বেনজীরের স্ত্রী জীশান মির্জার নামে ২৭৩ বিঘা জমি কেনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বেনজীর আহমেদ অবসরে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে স্ত্রী জীশান মির্জার নামে এসব জমি কেনা হয়। এসব জমির রেজিস্ট্রি মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ২১ লাখ টাকা। আদালতে উপস্থাপন করা দুদকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মির্জার নামে ১১৪টি দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়।

দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ৫ মার্চ বেনজীর আহমেদ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে মোট ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট আয়তনের চারটি ফ্ল্যাট মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকায় কিনেছেন। তবে বাস্তবে এই ৯ হাজার বর্গফুট রিয়েল এস্টেটের মূল্য হবে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকা। এই চারটি ফ্ল্যাট ছাড়াও মেয়ের ‘বিশ্রামের জন্য’ সাড়ে ৩ কোটি টাকা দিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনেন বেনজীর। ২০১৭ সালে র‌্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুটের এ ফ্ল্যাট কেনেন তিনি। এছাড়া বেনজীরের দুই মেয়ের নামে বেস্ট হোল্ডিংস ও পাঁচতারা হোটেল ‘লা মেরিডিয়ান’-এর ২ লাখ শেয়ার রয়েছে বলে জানা যায়। ৫৫ টাকা অধিকমূল্যে ৬৫ টাকা প্রতিটি শেয়ারের দর হিসাবে এই কোম্পানিতে বেনজীরের দুই মেয়ের বিনিয়োগ ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

দুদক অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজে বিতর্কিত হয়ে দেশজুড়ে আলোচিত নাম মোতাজেরুল ইসলাম মিঠুর সঙ্গে বেনজীর আহমেদের ব্যবসা রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে দুদক। উত্তরাঞ্চলের দুটি জেলায় কয়েকশ বিঘা জমি কিনেছেন তারা। তার মধ্যে অন্তত তিনটি জায়গায় শত বিঘার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে ‘নর্থ পোলট্রি খামার’। মুরগির খাদ্যের ব্যবসাও আছে তাদের। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বড় খোজাবাড়ি এলাকায় বিশাল পোলট্রি খামার রয়েছে। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নে ভিন্ন জগৎ পার্কসংলগ্ন এলাকায় একই নামে রয়েছে আরেকটি খামার। এছাড়া কিশোরগঞ্জ উপজেলার ধরেয়ার বাজার এলাকায় আরো একটি খামার রয়েছে। এসব খামারে নামে-বেনামে কয়েকশ বিঘা জমি কেনা হয়েছে বলে জানা গেছে। মিঠুর ভাই মানিক হাজি এই খামারগুলো দেখাশোনা করেন।

বান্দরবানেও বেনজীরের ৮০ একর জমির খোঁজ : বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-কন্যার নামে বান্দরবানে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। এসব সম্পত্তি দেখাশোনা করেন বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মং ওয়াইচিং মারমা। জানা যায়- বান্দরবান পৌরসভার মধ্যমপাড়া এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে শাহজাহানের কাছ থেকে বান্দরবান সদর উপজেলার ৩১৪ নম্বর সুয়ালক মৌজায় ৬১৪ নম্বর দাগের ৩ নম্বর সিটে ২৫ একর লিজের জমি ক্রয় করেন বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জীশান মির্জা ও মেয়ে ফারহীন রিশতা বিনতে বেনজীর। যেখানে গড়ে তুলেছেন গবাদি পশুর খামার, মৎস্য প্রজেক্ট, ফলজ, সেগুন বাগান ও বিলাসবহুল খামারবাড়ি। এই খামারবাড়িতে রয়েছে অন্তত অর্ধকোটি টাকারও বেশি গবাদিপশু। এ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *