‘ক্ষমতার খেলায়’ সর্বস্বান্ত ২৯৭ কৃষক
সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের সৈয়দতলী এলাকার কৃষক মোজাম্মেল। দুই মাস আগে ১০ একর জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। আর দুমাস গেলেই অন্তত লাখ খানেক টাকার আলু উঠতো তাঁর ঘরে। তবে এর আগেই তাঁর ক্ষেতে ‘খাল কেটে কুমির’ এনেছে বনবিভাগ।
শুধু কৃষক মোজাম্মেল নয়, তাঁর মতো মাথায় হাত সাতকানিয়ার ২৯৭ কৃষকের। ৫২ লাখ টাকার বেশি ফসল বানের জলে ভেসে গেছে।
লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নে আড়াই হাজার একর বনভূমি ডুবিয়ে তৈরি করা কৃত্রিম লেকের বাঁধ অপরিকল্পিতভাবে কেটে দেয়ায় এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি। সদ্য সাবেক এমপি ড. আবু রেজা নেজামুদ্দীন নদভীর ঘনিষ্ঠ লোকজন ওই লেকে ‘মাছের ব্যবসা’ শুরু করেছিলেন। তড়িঘড়ি করে এ বাঁধ কাটানোর পেছনে ‘ক্ষমতার খেলা’ দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। লেকের মাছ ভাসানোর ফন্দি থেকেই এই বাঁধ কাটতে এই হুড়োহুড়ি বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাঁধকাটা বানে সাতকানিয়া উপজেলার কালামিয়া পাড়া, সৈয়দতলী ও বাংলাবাজারের আংশিক এলাকার আবাদি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ১০ একর জমির আলু, ১২ একর বোরো ধান, ২৫ একর রবি শস্য, ২ একর পান, ৩ একর পেঁপে, সাড়ে তিন একর মরিচের গাছসহ মোট ৫৫ একর জায়গার ফসল নষ্ট সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫২ লাখ টাকা।
কৃষি বিভাগ বলছে, কোনো ধরনের পরামর্শ ছাড়া বনবিভাগ তাদের ইচ্ছেমতো অভিযান পরিচালনা করেছে। অভিযানের আগে কৃষকদের স্বার্থে কৃষি বিভাগ নয়তো স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করা খুবই প্রয়োজন ছিল। তাহলে কৃষকদের এই ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না।
তাদের মতে, বাঁধকাটা এ পানি কৃষি কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। যদি কৃষি বিভাগের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতো তাহলে ধাপে ধাপে পানি ছেড়ে ক্ষেতের কাজেই লাগানো যেত।
স্থানীয় প্রশাসন সরকারি প্রণোদনার আশ্বাস দিলেও ক্ষতি কিঞ্চিৎ পরিমাণ মিলবে বলেও আশা করছেন না ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষক মোজাম্মেল সিভয়েস২৪-কে বলেন, এনজিও থেকে সুদে টাকা নিয়ে আলু চাষ করেছিলাম। আর কিছুদিন পরেই কমপক্ষে লাখ খানেক টাকার আলু ঘরে তুলতে পারতাম। এখন আমার সবই শেষ। এখন পর্যন্ত চাল, ডাল, মুড়ি ছাড়া কিছুই পাইনি। প্রশাসনের লোকজন আশা দিচ্ছেন, তবে আমি আশা করছি না। সরকারি ভাবে আর্থিক সহায়তা পেলে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও লাগব হয়।
কৃষক শাহ আলম বলেন, ‘এক রাতে আমার তিন কানি জমির বোরো ও এক কানি সবজিক্ষেত সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে। সুদের টাকা নিয়ে ক্ষেত করেছিলাম, লাভ তো গেল, ঋণ কীভাবে শোধ করবো।’
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ সে মতে ব্যবস্থা নেবেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহযোগিতা করার সুযোগ নেই কৃষি বিভাগের নেই। স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে এ বিষয়ে রিপোর্ট যাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে। প্রণোদনা কিংবা প্রকল্প নিতে হবে মন্ত্রণালয় থেকেই।’
সাতকানিয়া উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, অভিযানের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কাটার কারণেই কৃষির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে পাঠিয়েছি।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ-আল-মামুন বলেন, গত শনিবার কৃষকদের আবাদনের প্রেক্ষিতে বাঁধকাটা হয়েছিল। সকাল থেকে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু পিরে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য সরকারি ভাবে প্রণোদনার জন্য আগামী সপ্তাহের মধ্যে বনবিভাগ থেকে জরিপ করা হবে।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিল্টন বিশ্বাসকে বলেন, ইতি মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। এরপর সরকারিভাবে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হবে।