গাজার শিশুদের প্রতি চিঠি
গাজার শিশুদের প্রতি চিঠি
‘আমরা তোমাদের কাছে ব্যর্থ,
এই ভয়ঙ্কর অপরাধবোধ আমাদের
কখনও ছেড়ে যাবে না’
প্রিয় শিশুরা, এখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। আমি আটলান্টিক মহাসাগরের হাজার হাজার ফুট উপর দিয়ে অন্ধকারে ঘণ্টায় শত শত মাইল বেগে উড়ছি। আমি মিশর যাচ্ছি, রাফাহতে গাজার সীমান্তে যাবো। তোমাদের জন্যই যাচ্ছি।
তোমরা কখনও বিমানে চড়োনি। কখনও গাজা ছেড়ে যাওনি তোমরা। ঘনবসতিপূর্ণ রাস্তা এবং গলিগুলোই কেবল তোমরা চেনো। আর দেখেছো গাজা ঘিরে থাকা সৈন্যদের টহল দেওয়া, নিরাপত্তা বাধা এবং বেড়াগুলো। প্লেন, ভয়ঙ্কর যুদ্ধবিমান, এপাচি হেলিকপ্টার কিংবা ড্রোন- এগুলো তোমাদের ওপর বৃত্তাকারে ঘুরে বেড়ায়। তারা ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা ফেলে। বধিরকারী বিস্ফোরণ। মাটি কাঁপছে। ভবন ধসে পড়ছে অবিরাম। চারদিকে চিৎকার, আহতদের আহাজারি, লাশ। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি। থেমে থাকে না দিনরাত ভাঙা কংক্রিটের স্তূপের নিচে আটকা পড়াদের এ অর্তনাদ। তোমার খেলার সাথী, তোমার সহপাঠীরা, তোমার প্রতিবেশীরা চোখের পলকেই নেই হয়ে গেছে। খোঁড়াখুঁড়ির সময় হয়তো পরিচিতজনের ধুলোমাখা মুখটিও তোমাকে দেখতে হয়েছে, হচ্ছে। আমি একজন রিপোর্টার। এটা দেখা আমার কাজ। তুমি একটা শিশু, তোমার এমন দৃশ্য কখনওই দেখা উচিত নয়। কিন্তু তুমি বাধ্য।
চারদিকে মৃত্যুর দুর্গন্ধ। ভাঙা কংক্রিটের নিচে পচা লাশ। তোমার পাড়াটা কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। পরিচিত যা কিছু ছিল সব শেষ। তুমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকো। বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণে তুমি ভীত। তুমি কাঁদো। মা বা বাবাকে আঁকড়ে ধরে থাকো। তুমি কান ঢেকে রাখো। একটু পরেই হয়তো দেখতে হবে তীব্র আলোসহ বিস্ফোরণের ভয়াবহতা।
কেন তারা শিশুদের হত্যা করে? তুমি কী করেছিলে? কী তোমার অপরাধ? কেন কেউ তোমাকে রক্ষা করতে পারে না? তুমি কি আহত হবে? একটা পা বা হাত কি হারাতে চলেছো তুমি? নাকি অন্ধ হয়ে যাওয়াই কপালে আছে তোমার? একটা হুইলচেয়ার কি জুটবে তোমার কপালে? কেন জন্মেছিলে তুমি? এটা কি ভালো কিছুর জন্য ছিল? নাকি এই নারকীয়তা দেখার জন্য? তুমি কি সুখী হবে? বন্ধুদের ছাড়া তখন কেমন লাগবে তোমার?.. এরপর কে মরবে? তোমার মা? তোমার বাবা? তোমার ভাই-বোনেরা? তোমার পরিচিত কেউ কি আহত হতে চলেছে?.. হ্যাঁ। শীঘ্রই তোমার পরিচিত কেউ মারা যেতে চলেছে নিশ্চয়ই।
রাতে সিমেন্টের ঠান্ডা মেঝেতে অন্ধকারে শুয়ে থাকো তোমরা। ফোনের তার কাটা। ইন্টারনেট বন্ধ। কোথায় কী ঘটছে জানার উপায় নেই।
কেবল আলোর ঝলকানি আছে। আছে বিস্ফোরণের ভয়ঙ্কর শব্দ। চিৎকার।.. চলছেই। থেমে থাকে না। বাবা বা মা খাবার বা পানির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তুমি আশায় থাকো। পেটে সেই ভয়ঙ্কর অনুভ‚তি। তারা কি ফিরে আসবে? তাদের কি আবার দেখতে পাবে তুমি? তোমাদের ছোট্ট বাড়িটি কি পাশে থাকবে? পরের বোমাটি কি তোমাকেই খুঁজে নিতে চলেছে? এই পৃথিবীতে কি তোমার শেষ মুহূর্তটা আসন্ন?
নোনতা, নোংরা জল পান করতে হয় তোমাকে। এটা তোমাকে খুব অসুস্থ করে তোলে। তোমার পেট ব্যাথা করছে। তুমি ক্ষুধার্ত। বেকারিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। রুটি নেই। দিনে এক বেলা হয়তো খাবার জুটছে। ন্যাকড়া দিয়ে তৈরি ফুটবল দিয়ে আর খেলতে পারো না তুমি। কিংবা পুরনো খবরের কাগজ থেকে তৈরি ঘুড়িটাও আর উড়ানোর কথা তোমার মাথায় আসে না।
তুমি বিদেশি সাংবাদিকদের হয়তো দেখেছো- ‘PRESS’ লেখা ফ্ল্যাক জ্যাকেট পরা। আমাদের হেলমেট আছে। আমাদের ক্যামেরা আছে। আমরা জিপ চালাই। আমরা একটি বোমা হামলা ইত্যাদির ছবি তুলি, কফি খেতে খেতে বড়দের সাথে কথা বলি। তারপর আমরা অদৃশ্য হয়ে যাই। আমরা সাধারণত শিশুদের সাক্ষাতকার নিই না। কিন্তু আমি সাক্ষাতকার নিয়েছি যখন তোমাদের দলগুলো আমাদের চারপাশে ভিড় করেছে। এতকিছুর পরেও তোমাদের হাস্যময় চেহারা প্রমাণ দেয় তোমরা কতটা ‘ইনোসেন্ট’।
জানো, আমরা যারা যুদ্ধে রয়েছি তারা সবচেয়ে বেশি যুদ্ধকে ঘৃণা করি- কারণ এটি শিশুদের জন্য কী করে তা আমাদের চাক্ষুষ করতে হয়।
আমি আমার গল্পে তোমাদের কথা বলার চেষ্টা করি। আমি বিশ্বকে বলার চেষ্টা করি- সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, দশকের পর দশক যখন আপনারা মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে অস্বীকার করেন, যখন আপনারা তাদের অপমান করে খোলা হাওয়ার কারাগারে আটকে রাখেন, হত্যা করেন, তখন আপনারা আসলে সব পশু হয়ে যান। তারা খুব রেগে যায়।
অনেক সাহসী ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আছে। এই বোমা হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে অনেকেই নিহত হয়েছে। তারা হিরো। তোমাদের হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সরাও তাই। জাতিসংঘের কর্মীরাও তাই। যার মধ্যে প্রায় শতজন মারা গেছেন। এম্বুলেন্স চালক এবং চিকিৎসকরাও তাই। উদ্ধারকারী দলগুলোও তাই যারা হাত দিয়ে কংক্রিটের স্ল্যাব তুলে নেয়। তোমাদের মা এবং বাবা যারা তোমাদের বোমা থেকে রক্ষা করে- তারাও তাই।
কিন্তু আমরা, সারাবিশ্বের সাংবাদিকরা রাফাহ সীমান্তে যাচ্ছি। আমরা যাচ্ছি কারণ আমরা এই হত্যা দেখতে আর পারছি না এবং কিছুই করতে পারছি না। আমরা যাচ্ছি কারণ শত শত শিশুসহ প্রতিদিন সহস্র মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরা যাচ্ছি কারণ এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।
আমরা যাচ্ছি- কারণ আমাদেরও সন্তান আছে। তোমাদের মতো- যাদের জীবন মূল্যবান, নির্দোষ- যারা ভালবাসতে জানে। আমরা যাচ্ছি কারণ আমরা জানি তোমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে।
আশা করি একদিন দেখা হবে। তোমরা একদিন প্রাপ্তবয়স্ক হবে। আমি আরও বৃদ্ধ হবো, যদিও তোমাদের কাছে আমি ইতোমধ্যেই অনেক বৃদ্ধ। তোমাদের জন্য আমি স্বপ্নে দেখি- একদিন তোমরা মুক্ত ও নিরাপদ এবং সুখী জীবন পাবে। কেউ তোমাদের আর হত্যা করার চেষ্টা করছে না। তোমরা বোমা নয়, মানুষভর্তি বিমানে উড়ছো। কোনও একটি বন্দিশিবিরে আটকা পড়া নয়, দেখবে পৃথিবী ঘুরে। একদিন বড় হবে এবং তোমাদেরও সন্তান হবে। তোমরা বুড়ো হয়ে যাবে। এই যন্ত্রণার কথা মনে থকবে তোমাদের, কিন্তু তুমি জেনে রাখো যে, এর অর্থ তোমাকে অবশ্যই অন্যদের সাহায্য করতে হবে, যারা কষ্ট পায়। এই আমার আশা, আমার প্রার্থনা।
আমরা আসলে ব্যর্থ। এখনও কিছু করে উঠতে পারিনি তোমাদের জন্য। এই ভয়ঙ্কর অপরাধবোধ আমাদের বহন করে চলতে হবে। আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেটা হয়তো যথেষ্ট ছিল না। আমরা লিখবো এবং ফিল্ম করবো। এর মধ্য দিয়ে তোমাদের গল্প বিশ্ববাসীকে জানিয়ে যাবো। হয়তো এর মধ্য দিয়ে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার অধিকারটি অন্তত পাবো।-ভাবানুবাদ
সূত্র : শিয়ারপোস্টডটকম, কানাডিয়ান ডাইমেনশন
[মূল লেখক : ক্রিস হেজেস। তিনি একজন পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক। নিউইয়র্ক টাইমসের সর্বাধিক বিক্রিত লেখক, রাটগার্স ইউনিভার্সিটি কর্তৃক নিউজার্সি রাজ্যের বন্দীদের দেওয়া কলেজ ডিগ্রি প্রোগ্রামের একজন অধ্যাপক এবং একজন নিযুক্ত প্রেসবিটেরিয়ান মন্ত্রী। তিনি ১২টি বই লিখেছেন। তিনি ScheerPost ওয়েবসাইটের জন্য সাপ্তাহিক কলাম লিখেন।]