চট্টগ্রাম

ঘুষের ‘দরদাম’ হলে সিগন্যাল দেন ঝাড়ুদার

টেবিলে আসা দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে নিখুঁতভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর বের করা হয় ‘খুঁত’। খুঁতের অজুহাতে ফাইল চলে যায় দরজার বাইরে। এরপর বড়ছোট খুঁত হিসেব করে চলে ঝাড়ুদারের দেনদরবার। ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত এ দেনদরবারের কারবার। দরেদামে মিলে গেলে বাইরে থেকে ইশারায় যায় সিগন্যাল। এরপরই রেজিস্ট্রির দলিলে কলম বসে সাব রেজিস্টারের।

চুক্তি ছাড়া যেসব দলিল-দস্তাবেজ টেবিলে ওঠে তাদের সঙ্গে দেনদরবারের এই কারবারের অভিযোগ সীতাকুণ্ড সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সাব রেজিস্টার রায়হান হাবীবের বিরুদ্ধে।

দলিল লেখক ও সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, ঘুষের চুক্তি না করে রেজিস্ট্রি করতে গেলেই এমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। দলিলে কোন সমস্যা না থাকলেও কিছু না কিছু খুঁত বের করে দলিল ফেরত দেওয়া হয়। ঝক্কিঝামেলা এড়াতে তখন আর কোন উপায় না পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই দলিল রেজিস্ট্রির জন্য গ্রাহক ও দলিল লেখকের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। তখন তিনি অফিসের ঝাড়ুদার ইয়াকুবের সাথে বাইরে গিয়ে কথা বলতে বলেন। সাব রেজিস্টারের ইশারায় দলিলের মূল্য অনুযায়ী ১৫ হাজার থেকে শুরু করে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ চান ইয়াকুব। দরদাম চূড়ান্ত হলে সাব রেজিস্টারকে গ্রীন সিগন্যাল দেয় ইয়াকুব। তখন তিনি আর কিছু যাচাই-বাছাই না করে দলিল সম্পাদন করে দেন।

অন্যদিকে ঘোষণাপত্র দলিল, বন্টক নামা দলিল, সংশোধনামা দলিল ও ওছিয়ত নামা দলিল রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার বিনিময়ে ইচ্ছামতো দর হাঁকছেন ঝাড়ুদার ইয়াকুব। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘুষের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেসব দলিলে ওয়ারিশ সনদ সংযুক্ত থাকে এসব দলিল থেকে প্রতিটি সনদের বিপরীতে ৫ হাজার টাকা নির্ধারিত হারে আদায় করা হচ্ছে। দুটি খতিয়ান থেকে একই দলিলে রেজিস্ট্রি করতে হলে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নির্ধারিত করা হয়েছে। এছাড়া অন্য সব দলিলে কোনটাতে কত টাকা চুক্তি করা হয়েছে সেটা ইয়াকুবের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়ে দলিলের উপরে পেন্সিল দিয়ে লিখে দেন কেরানী। আবার দিনশেষে সবগুলো দলিল চেক করে টাকার অংক মিলিয়ে সাব রেজিস্টারকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর সংখ্যাটা মুছে দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন দলিল লেখক বলেন, ‘এমন কোন দলিল নেই যেটাতে সাব রেজিস্টার ঘুষ নেন না। আমরা সব দলিলেই অনেকটা অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী ৫ শতাংশ বাড়তি টাকা দিয়ে আসছি। অর্থাৎ একটি দলিলের জমির মূল্য যদি এক কোটি টাকা হয় অফিস খরচ দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা। সরকারি ফির বাইরে এটা সম্পূর্ণ অবৈধ টাকা। এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সেটা আমরা আগে থেকে দিয়ে আসছি তাই এটা নিয়ে আমাদের আপত্তি নাই। কারণ এটা অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে। অথচ এই নতুন সাব রেজিস্ট্রার স্যার আসার পর যেকোনো ঠুনকো অজুহাতে দলিল ফেরত দিচ্ছে এবং ঘুষের চুক্তি ছাড়া যারা রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল নিয়ে যাচ্ছে তাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করছেন।

তবে ঝাড়ুদার ইয়াকুবের সাথে ঘুষের দরদাম ফাইনাল হলেই কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই দলিল সম্পাদন করে দিচ্ছেন সাব রেজিস্টার। এই নিয়ে আমরা দুই দফায় গত ৬ জুন ও ৯ জুন তারিখে সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে বৈঠক করি। দুই দফা বৈঠকে সাব রেজিস্টার স্যারকে অনেক অনুরোধ করেও কোন লাভ হয়নি। তিনি আমাদেরকে উল্টো ধমকিয়ে বলেন, ‘আমি বিসিএস ক্যাডার, এছাড়াও ৯০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে আমি এখানে এসেছি। আমার উপরে থাকা আরও ৮ জনকে ডিঙ্গিয়ে আমি এই চেয়ারে বসেছি। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনাদের ধারণা থাকা উচিত।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে ঝাড়ুদার ইয়াকুব বলেন, ‘আমি এখন করি না, করবোও না। এগুলো ভিত্তিহীন। আমার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হচ্ছে।’

একইভাবে নিজের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন সাব রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিব। তিনি বলেন, ‘আগে হয়তো ভিন্ন নিয়মে দলিল রেজিস্ট্রি হত। এখন এনবিআর আমাদেরকে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মে দলিল রেজিস্ট্রির নির্দেশনা দিয়েছে। তাই হয়তো দলিল লেখকদের সাথে আমাদের কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া ঘুষ গ্রহণ কিংবা ঘুষ প্রদান করে সীতাকুন্ড আসা এসব অপপ্রচার। আমার বিরুদ্ধে একটি পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়ে এসব বদনাম ছড়াচ্ছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *