চট্টগ্রামে কিশোর অপরাধীদের হাতে আট দিনে ৪ খুন
চট্টগ্রামে অপরাধের নিয়ন্ত্রণ এখন কিশোর অপরাধীদের হাতে। খুন, জখম থেকে ছিনতাই, চাঁদাবাজি সবকিছুতেই উঠে আসছে কিশোর অথবা সদ্য কৈশোর পেরুনো তরুণদের নাম। অভিযান, গ্রেপ্তার কোনোকিছুই থামাতে পারছে না এ অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। চট্টগ্রামে গত আট দিনে চারটি খুনের ঘটনায় উঠে এসেছে এমন কিশোরদের নাম, যাদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে থানায় কোনো অভিযোগ ছিল না। হিরোইজম, কাঁচা টাকা–পয়সা, মাদকাসক্তি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত বাড়ছে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা। সেই সাথে টিকটক, লাইকিসহ নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে অনেকে।
র্যাব–৭ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মাহবুব আলম বলেন, দেশে কিছু অপসংস্কৃতির প্রভাব ঘটেছে, তার একটি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। অন্যান্য জেলার মতো চট্টগ্রাম মহানগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য রয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কিশোর গ্যাংয়ের ওপর নজরদারি রাখার পাশাপাশি আমরা অভিযান শুরু করেছি। এ অবক্ষয় রোধে পারিবারিকভাবে নৈতিক শিক্ষা আরো জোরদার এবং সন্তান কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে এসব বিষয়ে অভিভাবকদের আরো সচেতন হতে হবে। কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোর অপরাধ দমন তাদের কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। তারপরও কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না।
সর্বশেষ গত ৮ জুন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে মোটরসাইকেলের বিকট হর্ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে এক পক্ষের ওপর আরেক পক্ষের হামলা ও ছুরিকাঘাতে একজন নিহত ও আরেকজন আহত হন। পুলিশ বলছে, এটি কিশোর গ্যাংয়ের কাজ। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। তাদের কাছ থেকে ঘটনায় ব্যবহৃত ছুরিটি উদ্ধার করা হয়েছে।
সিএমপির উপকমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা বলেন, ঘটনায় জড়িতদের বেশিরভাগই সদ্য কৈশোর পেরিয়ে উঠতি বয়সের তরুণ। ধরে নেওয়া যায়, এটি কিশোর গ্যাংয়ের হত্যাকাণ্ড। ৪ জনের ওপর ১৫ জনের একটি দল হামলা চালায়। পাড়া–মহল্লায় যেসব কিশোর গ্যাংয়ের ঘটনা ঘটে এটি সেগুলোর মতো একটি ঘটনা।
৩ জুন রাতে নেশা করার জন্য টাকা চেয়ে না পাওয়ায় নগরীর পাহাড়তলীতে ছেলে ওমর ফারুকের (১৮) হাতে খুন হন মা রিনা আক্তার।
পাহাড়তলী জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. মঈনুর রহমান বলেন, পুলিশ হেফাজতে ওমর ফারুক দুপুরের খাবার খেয়েছে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই কয়েক ঘণ্টা আগে সে গর্ভধারিণী মাকে উপর্যুপরি কোপে খুন করেছে। ফুরফুরে মেজাজে ছিল। ওমর ফারুক সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীর একটি কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। মাকে খুনের পর তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি।
গত ৩ জুন নগরীর আগ্রাবাদে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে মো. নুরুল আজিম নামে এক কিশোর খুন হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ নয়ন, মোহাম্মদ সোহেল, মোহাম্মদ রনি ও মামুন নামের ৪ কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বয়স ১৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। পুলিশ বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। পরে তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে নিহত আজিম চাড়িয়াপাড়া এলাকায় একা দাঁড়িয়েছিল। এ সময় ১০ থেকে ১২ জন তরুণ এসে তাকে ছুরিকাঘাত করে। এতে তার মৃত্যু হয়।
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী বলেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একসময় ভুক্তভোগী আটকদের মারধর করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে সেই ঘটনার জেরেই এই হত্যাকাণ্ড।
১ জুন বোয়ালখালীতে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে স্কুলছাত্র আরিফ হোসেনকে (১৫) খুন করেছে সাকিবুল ইসলাম নামে ১৪ বছরের এক কিশোর। এ ঘটনায় পরদিন নিহত আরিফের পিতা জাগির হোসেন বাদী হয়ে মামলা করলে অভিযুক্ত ওই কিশোর ও তার মাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আরিফ শাকপুরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থী।
বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আছহাব উদ্দিন বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় সারোয়াতলী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড বেঙ্গুরা দেলোয়ার হোসেন সওদাগর বাড়ির বাসিন্দা জাগির হোসেনের স্কুল পড়ুয়া ছেলে আরিফের সাথে স্থানীয় একটি বিলে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে একই এলাকার বাসিন্দা রফিক মিয়ার ছেলে সাকিবুল ইসলামের ঝগড়া হয়। এ নিয়ে আরিফকে সাকিব ও সাকিবের মা সাথী আকতার (৩৫) মারধর করে। এতে আরিফ জ্ঞান হারিয়ে রাস্তার ধারে পড়েছিল। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।