চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে বেড়েছে শিশুশ্রম

বয়স আনুমানিক ৮-১০ বছর। এ বয়সেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছে শিশু (ছদ্মনাম) মো. জিয়াকে। অল্পবয়সেই পিতাকে হারায় জিয়া। মা মানুষের বাসায় কাজ করে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মায়ের একার আয়ে চলে না চারজনের সংসার। তাই এ বয়সে যেখানে স্কুলে যাওয়ার কথা, তা না করে মায়ের সাথে সংসারের হাল ধরতে এলুমিনিয়ামের কারখানায় কাজ করতে হয় তাকে। এমন অবস্থা শুধু নগরীর মুরাদপুরের এলুমিনিয়াম কারখানায় কাজ করা শিশু জিয়ার নয়, এখানে প্রায় ছয় শতাধিক শিশুর একই অবস্থা।

ইপসা ফ্রি কিডস প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, করোনা পরবর্তী গত দু’বছরে চট্টগ্রামে আবার বেড়েছে শিশুশ্রম। বিশেষ করে এলুমিনিয়াম কারখানায় শিশুশ্রমিকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নির্মাণ শ্রমিকের কাজে। এছাড়া গাড়ির হেলপারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও শিশুশ্রমিক রয়েছে। এর কারণ করোনায় অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন। যদিও গত দু’বছরে এ সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে মানুষ। কিন্তু পূর্বের জায়গায় এখনও ফিরে আসেনি। ভোগ্যপণ্যের চড়া দামের কারণে একজনের আয়ে এখন সংসার চলে না। আয়ের সাথে ব্যায়ের মিল না থাকায় শিশুশ্রম বেড়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম প্রতিবেদন মতে, দেশে শিশুশ্রম বেড়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ শিশুশ্রমিকমুক্ত করার লক্ষ্য ঠিক হলেও পরিস্থিতি উল্টোদিকে গড়ানোর চিত্র উঠে এলো সরকারি এক জরিপে। বর্তমানে কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার। যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। প্রতিবেদন মতে, ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ শিশু শ্রমের সঙ্গে জড়িত। যা ২০১৩ সালে ছিল ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল। এদের বয়স ৫ থেকে ১৪ বছর। এদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে আছে ১০ লাখ ৬৮ হাজার।

এলুমিনিয়াম, শুঁটকি, লোহার কারখানাসহ ৪৩ ঝুঁকিপূণ সেক্টরে কাজ করে- এমন শিশুদের নিয়ে চট্টগ্রামে শিশুশ্রম নিরসনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা তিনটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। উদ্যোগগুলো হল- ৬ থেকে ১৪ বছরের ঝরে পড়া শিশুদের পুনঃভর্তির ব্যবস্থা করা; ১৪ থেকে ১৮ বছরের শিশুদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভারী কাজ থেকে সরিয়ে নিরাপদ কাজের আওতায় আনা; তাছাড়া অভিভাবকদের আয় বৃদ্ধিকরণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, যার মাধ্যমে শিশুশ্রম নিরসনের পাশাপাশি সচ্ছল পরিবার গড়ে তোলা।

ইপসা’র সমন্বয়কারী মো. আলী শাহিন বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে এসব শিশুর ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে দু’মাসের ট্রেনিং করানো হচ্ছে। সপ্তাহে ছয়দিন ৫ ঘণ্টা করে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। এসব ট্রেনিংয়ের মধ্যে রয়েছে- ইলেকট্রনিক এন্ড হাউস ওয়ারিং এবং মেয়েদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ। প্রতিব্যাচে ২৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ চলাকালে শিশুকিশোরদের প্রতিমাসে ৬ হাজার টাকা বেতনও দেয়া হচ্ছে। যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছর- প্রশিক্ষণ শেষে তাদের ইন্টার্নশিপ এবং জবের ব্যাবস্থা করা হবে। এছাড়া তাদের অভিভাবকদের আয়বৃদ্ধিকরণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে শিশুশ্রম নিরসনের পাশাপাশি সচ্ছল পরিবার গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সীতাকুণ্ড উপজেলা, নগরীর ৪১ ওয়ার্ডসহ কক্সবাজারের ১৮০ শিশুশ্রমিককে ইপসা ফ্রি কিডস প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয়েছে।

সলিডার সুইস’র কনসালট্যান্ট মো. জাকারিয়া জানান, বেইজ লাইন সার্ভের জন্য ৪৭৬ জন শিশুশ্রমিক ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে জরিপ চালানো হয়। তার মধ্যে ৪৩ শতাংশ শিশুশ্রমিক বার্ষিক চুক্তিতে কাজ করে। যেটি একপ্রকার জবরদস্তিমূলক পেশা। শুঁটকি শিল্পে ৮০ শতাংশ শিশু মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এবং মেটাল সেক্টরের ৮৯ শতাংশ শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সারাবছর নিয়োজিত। এসব শিশুশ্রমিক সামাজিক সুরক্ষা সেবা থেকে বঞ্চিত। বর্তমান শিশুশ্রমের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও কিছু কিছু সেক্টরে শিশুশ্রমের পরিমাণ কিছুটা শিথিল। মূলত দরিদ্রতার কারণে শিশুরা এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত হচ্ছে। তাছাড়া এ সকল শিশুর পরিবারে শিক্ষার হার অনেক কম। যার কারণে শিশুদের শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই পরিবারের। এসব কারণে শিশুশ্রম বাড়ছে। শিশুশ্রমিকদের সুরক্ষা সেবার আওতায় নিয়ে আনা এবং বয়স অনুযায়ী ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করা গেলেই শিশুশ্রম অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *