চট্টগ্রামে স্বেচ্ছাসেবক লীগের পুনরুজ্জীবন, আজিজই ‘জিয়ন-কাঠি’
গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মতৎপরতায় ছিল না এতো জৌলুস। দিনকেদিন ম্রিয়মান হচ্ছিলো এ সংগঠনের সূর্য। এক সময়ে মিছিল করা বা ব্যানার ধরার লোক না থাকলেও সংগঠনটিতে এখন নেমেছে নেতা-কর্মীর প্রাণোচ্ছল ঢল। দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এখন অনেকটা পূর্বাহ্নের সূর্যকিরণের মতোই। নগরজুড়ে নেতা-কর্মীদের ব্যানার-ফেস্টুন বা মিটিং-মিছিলই জানান দিচ্ছে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের ভিত এখন অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, সমধিক পরিপক্ব। তবে সাংগঠনিকভাবে পিছিয়ে পড়া একটি সংগঠন রাতারাতিতে এমন ঔজ্জ্বল্যে পরিণত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে কিছু রাজনীতিকের মেদহীন ত্যাগ-শ্রম, সমর্পিত চিত্তের ঘামঝরা রাজনীতি।
২০২২ সালের মার্চে দেবাশীষ নাথ দেবুকে সভাপতি ও ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আজিজুর রহমান আজিজকে সাধারণ সম্পাদক করে মোট ২০ সদস্যের আংশিক নগর কমিটি ঘোষণা করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। মূলত এ কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পদে কর্মীবান্ধব ছাত্রনেতা আজিজুর রহমান আজিজের নেতৃত্বই প্রাণচঞ্চলতা ফিরিয়েছে এ জীবন্মৃত সংগঠনে। এক সময়ের তুখোড় মেধাবী ছাত্রলীগ নেতা আজিজুর রহমান আজিজের একদিকে ছিল বিশাল কর্মীবহর, তারপরও নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করে বাড়িয়ে নিয়েছেন সেই কর্মীবহরের যোজন যোজন পরিধি।
বিশেষত করোনাকালীন আজিজের মানবিক-জনকল্যাণকর উদ্যোগ নজর কেড়েছে নগরবাসীর। দায়িত্ব পেয়ে যুব সমাজকে সামাজিক-মানবিক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধকরণ, কন্যা দায়গ্রস্ত পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা, সাহায্য চাওয়া কোনো মানুষকে ন্যূনতম সহযোগিতা ছাড়া ফিরিয়ে না দেওয়া, রিকশাচালকদের জন্য রেইনকোর্ট, পথশিশুদের জন্য বুফে খাবার, ঈদ পুনর্মিলনীতে সাধারণের জন্য বুফে খাবার, আগুন লাগার ঘটনায় ছুটে যাওয়া; এক কথায় যে-কোনো প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ে কর্মীবহর নিয়ে ছুটে যাওয়া ছিলো চোখে পড়ার মতো।
এ ছাড়াও কলেজ রাজনীতি থেকেই নিজ কর্মীদের বিপদ-আপদে পাশে থাকার ব্যাপারটিও তৃণমূলের কাছে আজিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে বহুগুণে। এরপর নগরীর ৭টি থানা ও ১৩টি ওয়ার্ডের সম্মেলন শেষ করে কমিটি ঘোষণা করে দেবু-আজিজ কমিটি। যা দলের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের চেয়েও ঢের বেশি গতিশীলতা বাড়িয়ে দেয় নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের।
রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের মতো স্বেচ্ছাসেবক লীগের লাইমলাইটে আসাটা চৌকস নেতৃত্বেরই ফল। যে সংগঠন নিয়ে আগে কোনো টু-শব্দও হতো না। সংগঠন ছিল কী, ছিল না তাও অনেকে জানতো না। সেই সংগঠনের আজকালের অবস্থা রীতিমতো এক বিস্ময়ের ব্যাপার। আগে ছাত্রলীগ-যুবলীগের জন্য কর্মীরা পাগল ছিল। এসব সংগঠনে সদস্য হতেও অনেক তোড়জোড় করতো। আর এখন সেই পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগে।
এদিকে দৃশ্যত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের জৌলুস-কর্মকাণ্ড বাড়লেও বেশকিছু কারণে বহুবার গণমাধ্যমে নেতিবাচক শিরোনাম হয়েছে দেবু-আজিজ নেতৃত্বাধীন এ কমিটি। বিশেষত সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুর চাঁদাবাজির অভিযোগের মামলা সংক্রান্ত নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে ব্রিবত হতে হয়েছে খোদ কেন্দ্রীয় কমিটিকেও। যার বিরুপ প্রভাবও পড়েছে নগরের আওতাধীন বিভিন্ন ইউনিটে কর্মীসংগ্রহে ও নীতি-নৈতিকার প্রশ্নে।
অভিযোগ উঠেছিল, তার এ পদে আসীন হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে। যদিও তিনি শেষমেষ নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন এ অভিযোগ থেকে। সর্বশেষ ৭টি থানা ও ১৩টি ওয়ার্ডের কমিটি গঠন নিয়ে তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ। কমিটির ১৩ জন সিনিয়র নেতা বেঁকে বসেন ঘোষিত থানা-ওয়ার্ডের কমিটির বিরুদ্ধে। বিতর্কের জেরে কেন্দ্র থেকে এক সপ্তাহের জন্য নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবুও ব্যক্তি উদ্যোগে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ।
জানা যায়, ১৯৯৫ সালে ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হয়েই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিন হন আজিজ। ১৯৯৬ সালে বিএনপি-জোট সরকারের সময়ে চট্টগ্রামে অসহযোগ আন্দোলন সফল হয় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে। সেই আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের রোষানলে পড়ে মামলা-হামলার শিকার হওয়ার পাশাপাশি কারাগারেও যেতে হয়েছিল এই সাবেক ছাত্রনেতাকে। এরপর ২০০২ সালে কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও ২০০৪ সালে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই কমিটি বিলুপ্তির পর প্রায় সাত বছর ধরে কোনো রকম রাজনৈতিক পদ-পদবী ছাড়াই বিশাল কর্মীবহর নিয়ে দলীয় যে-কোনো কর্মকাণ্ডে ব্যাপক সরব অংশগ্রহণ ছিল আজিজুর রহমান আজিজের। দীর্ঘদিন ধরে পদের বাইরে থেকেও কর্মী ধরে রাখার ক্ষেত্রে চৌকস নেতৃত্বগুণের পরিচয় দিয়েছেন চট্টলবীর প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরীর স্নেহধন্য এ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা।
নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অপত্যস্নেহ-সাহচর্যই আজিজুর রহমান আজিজের রাজনৈতিক কন্টকাকীর্ণ পথচলাকে করেছে কুসুমাস্তীর্ণ। এ প্রসঙ্গে আজিজুর রহমান আজিজ বলেন, ‘নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি চট্টলবীর প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন আমার অভিভাবক। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সেসময় আমাকে নগর ছাত্রলীগের সভাপতি পদে আমার নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে তালিকা পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। আমার বিয়ের পাত্রীও ঠিক করেছেন মহিউদ্দিন ভাই। তিনি আমার বিয়ের সবকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে আজকে আমার এই অবস্থান। তার অনুপস্থিতিতে তারই সুযোগ্য উত্তরসুরী মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছি।’
নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের চলমান সংকট প্রসঙ্গে আজিজুর রহমান আজিজ বলেন, ‘আমরা সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র মেনেই কমিটি দিয়েছি। নগরের বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ডে সম্মেলনও করেছি। স্বেচ্ছাসেবক লীগের মতো আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনগুলো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে এতো তৎপর কিনা তা খোঁজ নিলে আপনারাই জানতে পারবেন। তারপরেও সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত আমাদের শিরোধার্য। আশা রাখি, এই স্থবিরতা কাটাতে সংগঠনের মান্যবর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। এবং আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আগামীতে সংগঠনকে আরও গতিশীল করতে সহযোগিতা-নির্দেশনা দিবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘কার্যক্রম বন্ধ রাখার কারণে সাংগঠনিকভাবে আমাদের মানবিক কাজগুলো থমকে গেছে। প্রথম রোজা থেকে মহানগরে দৈনিক দশটি পয়েন্টে দুই হাজার করে মোট ২০ হাজার মানুষের মাঝে ইফতার বিতরণ করে আসছি। সেদিক থেকে এই এক সপ্তাহে প্রায় ১৪ হাজার অসহায়, খেটে খাওয়া মানুষ ইফতারসামগ্রী প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেখে খারাপ লাগছে। আমরা গণমানুষের জন্যই রাজনীতি করি। দুঃসময়ে তাদের পাশে থাকাটা অত্যাবশ্যকীয় কাজ বলে বোধ করি।’
‘এ সংগঠন আগে কেউ করতেও চাই তো না। ডেকে ডেকে পদ দিতো। নেতৃত্ব সৃষ্টির বিন্দুমাত্র লেশ ছিল না। সভাপতি, সেক্রেটারি কাউকে জোর করে পদ দিতে চাইলেও নিতো না। আর এখন ওয়ার্ডের সভাপতি, সেক্রেটারি হওয়ার জন্য সংসদ সদসৌ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা পর্যন্ত সুপারিশ করতেছে। এক ওয়ার্ডে প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারির জন্য ন্যূনতম ৪-৫ জন প্রার্থী হচ্ছেন। আমরা মিলাতে পারছি না যে, এতো প্রার্থীর ভিড়ে কাকে ফেলে কাকে দেব। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকহারে বেড়েছে। এক কথায়, নেতৃত্বের গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে’— বলেন আজিজুর রহমান আজিজ।
প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের জুলাই মাসে অ্যাডভোকেট এইচএম জিয়াউদ্দীনকে আহ্বায়ক ও কেবিএম শাহজাহান ও সালাউদ্দিন আহমেদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক লীগের চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় কমিটি। গত ২০ বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি এই আহ্বায়ক কমিটির নেতারা। এমনকি থানা-ওয়ার্ড পর্যায়েও সব কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি তারা। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্তমান কমিটি।