চার দশকে খাতুনগঞ্জে হাজার কোটি টাকার প্রতারণা
দেশে ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের গোড়াপত্তন দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে। আস্থা-বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে এত দীর্ঘসময় ধরে এই বাজারের ব্যবসায়ীরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। কিন্তু গেলো কয়েক দশকে একের পর এক প্রতারণার ঘটনা ব্যবসায়ীদের আস্থা-বিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি নূর ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন ৭৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার পর খাতুনগঞ্জে প্রতারণার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত ডিও প্রথা শুরুর পর প্রতারণার ঘটনা বেড়েছে। চিড় ধরেছে আস্থায়। গেলো প্রায় চার দশকে ৭০-৭৫টি বড় প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। এসব প্রতারণার মাধ্যমে অর্ধসহস্রাধিক ব্যবসায়ীর অন্তত হাজার কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন প্রতারকরা। সবচেয়ে বড় প্রতারণার ঘটনা ঘটে ২০১১ ও ২০১৩ সালে। ২০১১ সালে ৪৫ ব্যবসায়ীর ১৪৮ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হন চৌধুরী এন্ড ব্রাদার্স এবং চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পাঁচ ভাই। আর ২০১৩ সালে ইয়াছির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোজাহের হোসেন ২৯ জন ব্যবসায়ীর দেড়শ কোটি টাকা নিয়ে দেশ ছাড়েন। জানা গেছে, খাতুনগঞ্জে প্রথম প্রতারণার ঘটনা ঘটে ১৯৮৬ সালে। সে সময় বিভূতিভূষণ তালুকদার নামে এক ব্যবসায়ী কয়েকজনের ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অন্তত দেড়ডজন প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ী ৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হন।
এরপরের দশকে ডিও ব্যবসা প্রথা শুরু হয় খাতুনগঞ্জে। এতে বেড়ে যায় প্রতারণার ঘটনা। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অন্তত ২৭টি প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কয়েকশ ব্যবসায়ীর ৩৩০ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেন ৩০ জন ব্যবসায়ী। তবে এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ২০০৮ সালে মৌলভী আলমের ৯০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা।
২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আরও অন্তত ২০টি প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় কয়েকশ ব্যবসায়ীর পাঁচশ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেন ২০ জন। এরপর ২০১৯ সালে রাশেদ উদ্দিন ও নাছির উদ্দিন কয়েক ডজন ব্যবসায়ীর প্রায় ৫০ কোটি টাকা নিয়ে মালয়েশিয়া চলে যান স্থায়ীভাবে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে সোনা মিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিনের ৭৫ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হওয়ার ঘটনাটি ঘটে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতারণার ঘটনগুলো অনেক সময় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে করা হয়। তবে এসব ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে ব্যবসা শুরু করেন। শুরুতে বিশ্বাস ও আস্থা তৈরি করে পরে সুযোগ বুঝে বড় অংকের অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যান।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দীন বলেন, প্রতারণার ঘটনা আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস নষ্ট করে দিচ্ছে। আমি নিজেও প্রতারণার শিকার হয়েছি। প্রতারকরা টাকা নিয়ে যায়। আর আমাদের ব্যাংকঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হয়। আইনের দুর্বলতার কারণে এসব ঘটনার যথাযথ বিচারও হয় না। প্রতারণার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর বিচারকার্য দ্রুত সম্পন্ন হওয়া দরকার।
একের পর এক প্রতারণার ঘটনায় আস্থা-বিশ্বাসে চিড় ধরছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ গরম মসলা ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি অমর কান্তি বণিক। তিনি বলেন, অবস্থা এমন হয়েছে যে এখন আর আমি বাকি ব্যবসা করি না। কাউকে বিশ্বাসের ওপর আর বাকি দেই না। নগদ পণ্য দিতে হচ্ছে। আমার মতো অনেকেই এখন বাকিতে পণ্য দেয় না।
খাতুনগঞ্জে একের পর এক প্রতারণার ঘটনায় বিভিন্ন সময় মামলা দায়ের হলেও বিচারের নজির খুব বেশি নেই। আত্মসাৎ করা অর্থ ফেরত পাওয়ার নজিরও কম। এজন্য আইনি দুর্বলতার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু বলেন, ডিও ব্যবসাসহ সকল কার্যক্রমে ঘাপলা থাকলেও লেনদেন হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। যখন কেউ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়, সে হয়তো টাকাগুলো পাচার করে, নয়তো আত্মসাৎ করে। এটা তো মানিলন্ডারিং। আইনত তাকে ধরা যাবে। তবে এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা থাকে। অনেকক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাও চুপ করে থাকেন।