চট্টগ্রামরাজনীতি

ছাত্রলীগের কমিটিতে শিবির আতঙ্ক, জুড়ে বসতে চায় পদহীনরাও

চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল। রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সময় ‘মিনি পাকিস্তান’ হিসেবে খ্যাত সাতকানিয়া উপজেলার অবস্থান চট্টগ্রামের দক্ষিণেই। তা ছাড়া চার দলীয় জোট সরকার আমলে বিএনপি-জামায়াতের একাট্টা নিয়ন্ত্রণ ছিল বাঁশখালী-চন্দনাইশসহ দক্ষিণের বিভিন্ন প্রান্তে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ক্ষমতা থাকাকালে সেই বলয় ভেঙে পড়লেও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটির মূল দুই পদ ঘিরে পুরোনো দুঃশ্চিন্তা নতুন করে ভাবাচ্ছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের। তা ছাড়া কমিটিতে বিতর্কিতদের স্থান দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তৃণমূলে চাপা ক্ষোভ দেখা গেছে।

অন্যদিকে নতুন কমিটি ঘোষণা ঘিরে যদি বড় ধরনের বিতর্ক এড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর্যন্ত বিষয়টি গড়াতে পারে বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এতে যোগ্য, ত্যাগী ও নির্যাতিতদের মূল্যায়ন হতে পারে বলে আশাবাদী তারা।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন নেতা বলেন, ‘আমরা শুনেছি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে সাতজনের নাম চূড়ান্ত করেছে। মূলত সাতজনের মধ্যে থেকেই প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি বাছাই করা হতে পারে। কিন্তু সেখানে শিবির-জামায়াতের সঙ্গে যোগসাজেশ আছে এমন দুজনের নাম পাঠানো হয়েছে। যারা কোনোদিন ছাত্রলীগের কোনো পদেই ছিল না, দল ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের মিছিলে দেখা গেলেও তাদের সঙ্গে শিবিরের আতাত আছে।’

এদিকে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা জানিয়েছেন, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির রূপরেখা অনেকটা প্রস্তুত। সহসাই আসছে নতুন কমিটি। ইতোমধ্যে ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং দক্ষিণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এরপর দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বৈঠকও হয়েছে। আলোচনা শেষে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য সাতজনের নাম পাঠিয়েছে। এ কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকে জামায়াত কানেকশন ও বিতর্কিত নেতাদের ঘিরে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যে পদহীন দুই নেতাকে ঘিরে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

নতুন কমিটিতে আলোচনায় আসা ছাত্রলীগের ৭ নেতা হলেন দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক (গত কমিটি) সহসভাপতি সাতকানিয়ার জয়নাল আবেদিন, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চন্দনাইশের চৌধুরী তানভির, সাবেক সহসভাপতি সাতকানিয়ার ইয়াছিন চৌধুরী জনি এবং একই উপজেলার ছাত্রলীগ নেতা ইরফান উদ্দীন, আনোয়ারা উপজেলার ছাত্রলীগ নেতা রবিউল হায়দার, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাশঁখালীর মামুনুর রহমান চৌধুরী এবং কর্ণফুলী উপজেলার ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসাইন সাজিদ। তবে শেষ মুহূর্তে তাদের বাইরে চমকও থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন শীর্ষ নেতারা।

আলোচনায় আসা সাতজনের মধ্যে রবিউল হায়দারের বিরুদ্ধে শিবির কানেকশনের অভিযোগ রয়েছে। আনোয়ারা উপজেলার রবিউল দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের মূল পদে আসছেন এমন খবর চাউর হতেই শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছাত্রশিবিরের একটি সমর্থক ফরমে রবিউল হায়দারের নাম দেখা যাচ্ছে। ফরমটি ২০১২ সালের বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া আলোচনায় আসা সাতকানিয়া উপজেলার ইরফান উদ্দীনের বিরুদ্ধে রয়েছে নারী নির্যাতন মামলাসহ একাধিক মামলা। পুলিশের ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সিডিএসএম (পিসিপিআর) এ তাকে ‘বিবাহিত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

একইভাবে ইরফান উদ্দীনের বাবা রমজান আলীর বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা ও ডাকাতিসহ নানা অভিযোগ। রমজান আলীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করার জন্য ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠায় কাঞ্চনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাসুদ জাহাঙ্গীর, যুগ্ম আহ্বায়ক হাসান মুরাদ লিটন ও যুগ্ম আহ্বায়ক আতাউর রহমান খোকন।

ওই চিঠিতে ইরফানের বাবা রমজান আলীকে জামায়াতের দোসর হিসেবে উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে। এমন সমালোচনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে রবিউল হায়দার কালবেলাকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক কিছু প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আমি এ বিষয় নিয়ে থানায় জিডিও করেছি। যারা মিথ্যা অভিযোগ করছে এবং মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও আমি আইনগত ব্যবস্থা নিব। একটু সময়ের অপেক্ষায় আছি। তবে কমিটি কবে কখন ঘোষণা দিবে এটা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতারাই জানেন।

অন্যদিকে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ইরফান উদ্দীনের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, চট্টগ্রামের দক্ষিণে আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াশিকা আয়েশা খান, শ্রম কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, সাবেক ভূমি মন্ত্রী ও এমপি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানসহ আরও কয়েকজন নেতা। বিব্রতকর পরিস্তিতি এড়াতে দলের শীর্ষ নেতাদের সুনজর চেয়েছে তৃণমূল। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির জন্য ইতোমধ্যে সাতজনের নাম পাঠানো হয়েছে। শিগগিরই কমিটি ঘোষণা হতে পারে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। সেসব অভিযোগ সত্য কিনা কেন্দ্রীয় কমিটি তদন্ত করছে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এম এ আহাদ চৌধুরী রায়হান কালবেলাকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত সাতজনের নাম কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। কয়েক দফায় বৈঠকও হয়েছে। যদি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসে, সেই বিষয়েও তদন্ত করা হবে। সকলের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি অনেকটা গোছানো হয়েছে। ত্যাগ ও যোগ্যতাসহ সবকিছু বিবেচনা করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক থাকলে যে কোনো মুহুর্তে নতুন কমিটির ঘোষণা আসতে পারে।’ একই কথা বললেন কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক সহসভাপতি জাকারিয়া দস্তগীরও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *