চট্টগ্রাম

ছাত্র-বহিরাগত ও কর্মচারীদের মিলেমিশে মাদক সেবন

বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ড বেড়েই চলছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে। বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো কিংবা দলবেঁধে মাদক সেবন হয়ে গেছে ক্যাম্পাসের খুব সাধারণ দৃশ্য।

ক্যাম্পাসে একাধিক প্রবেশ পথ থাকলেও চেকপোস্ট রয়েছে কেবল জিরো পয়েন্টে। তাই মূল ফটকে বাধার মুখোমুখি হলেও নিয়মিত ভিন্নপথে ক্যাম্পাসে ঢুকছে বহিরাগতরা।

তবে এসব বহিরাগত মাদক ব্যবসায়ীদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে সহযোগিতা করেন ছাত্রনেতা ও কর্মচারীরা। যার কারণে ক্যাম্পাস এলাকায় ইয়াবা-গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবন বেড়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাদক ব্যবসায়ীরা ছাত্র ও কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে হলে বসেই গ্রহণ করছে মাদক।

প্রায় প্রতিদিনই শহীদ আব্দুর রব হলের ছাদে, শাহ আমানত, শাহজালাল, সোহরাওয়ার্দী, এফ রহমান হলের চিহ্নিত বেশকিছু কক্ষে নিয়মিত বসে মাদকের আসর। এসব আসরে থাকেন বহিরাগত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা।

গত ২৬ মে রাত ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বহিরাগত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী মিলে মদ ও গাঁজা সেবন করার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি অভিযান চালায়। উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ও মাদকের সরঞ্জাম রেখে পালিয়ে যায় তারা।

গত ২৮ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের ৩৫৬ নম্বর রুমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী, একজন বহিরাগত ও একজন কর্মচারী মিলে ইয়াবা সেবনের আসর বসান। খবর পেয়ে সেখানে হাজির হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। এমন সময় প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতি টের পেয়ে দরজা বন্ধ করে পালিয়ে যায় তারা। রুমের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলেও জানালা দিয়ে ইয়াবা সেবনের দৃশ্য দেখা যায়।

এক ভিডিওতে দেখা যায়, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা দরজায় কড়া নাড়তেই হামাগুড়ি দিয়ে মোমবাতির আগুন নিভিয়ে আসর ভেঙে দেন তারা। পরে দরজা খুলে তাদের হাতেনাতে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এ দৃশ্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলের নয়, প্রায় প্রতিটি হলে বসে ইয়াবা সেবনের আসর। কেউ প্রতিবাদ করলেই দিতে হয় মাশুল। বের করে দেওয়ার হুমকি আসে হল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে দীর্ঘদিন পদক্ষেপ না নেওয়ায় মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে এই পাহাড়ি ক্যাম্পাস।

এদিকে চবির শাহ আমানত হলে বহিরাগত, শিক্ষার্থী ও কর্মচারী মিলে ইয়াবা সেবনের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন তৌহিদ হোসেনকে আহ্বায়ক ও ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রাশেদ-উন-নবীকে সদস্য সচিব এবং সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ রিফাত রহমানকে সদস্য করা হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত চলছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক তৌহিদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এ ঘটনা তদন্তে কমিটির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসেছি। এরইমধ্যে আমরা তদন্ত কাজ শুরু করেছি।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পুরো ক্যাম্পাস এলাকায় রয়েছে মাদকসেবীদের বিচরণ। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর চেয়ে বহিরাগতদের সংখ্যাই বেশি। সন্ধ্যার পরপরই কিছু লাইসেন্সবিহীন বাইক নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন বহিরাগতরা। একেকটি বাইকে তিন থেকে চারজন উঠলেও গতি থাকে বেপরোয়া, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তাগুলোতে চলাচলকারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই বাইকাররা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে প্রবেশই নয়, বরং ক্যাম্পাসকে তারা মাদকের আখড়া বানিয়েছে। মাদক সেবনের পাশাপাশি তারা বিক্রি করার জন্য নিরাপদ জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছে এই ক্যাম্পাস।

অভিযোগ রয়েছে, বহিরাগতরা কিছু ছাত্রনেতার মদদে ক্যাম্পাসকে মাদক সেবনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানানো হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সবকটি হলের বিভিন্ন কক্ষে মাদক সেবন ও বিক্রি চলে। এ ছাড়া জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন রেললাইন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পাশে, বোটানিক্যাল গার্ডেন, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ঝুপড়ি, আব্দুর রব হলের মাঠেও বসে মাদক সেবনের আসর।

সর্বশেষ ৬ জুলাই দিনব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি। এসময় বিপুল পরিমাণ গাঁজা উদ্ধারের পাশাপাশি প্রায় ৩০ জনের কাছ থেকে মোটরসাইকেলের চাবি ও আইডি কার্ড জব্দ করা হয়। এদের অধিকাংশই বহিরাগত। ক্যাম্পাসের বায়োলজিক্যাল পুকুর পাড়, সমাজবিজ্ঞান ঝুপড়ি, উন্মুক্ত মঞ্চ, বোটানিক্যাল পুকুর পাড় ও অতীশ দিপঙ্কর হল এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানরত প্রায় ১০টি মাদকসেবী গ্রুপ থেকে এসব মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। আটকদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীও ছিলেন।

জানতে চাইলে চবি প্রক্টর ড. অহিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্র, বহিরাগত ও কর্মচারী মিলে মাদক সেবনের ঘটনা তদন্তে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। মাদকের বিষয়ে আমাদের জিরো টলারেন্স। আমরা কাউকে ছাড় দিব না। প্রায় প্রতিদিন আমাদের সহকারী প্রক্টরদের নেতৃত্বে ক্যাস্পাসের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তাদের আমরা আটক করছি, সবাইকে পুলিশে সোপর্দ করা হচ্ছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাদের বিষয়ে আমরা একাডেমিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *