জব্বারের বলীখেলায় আয়-ব্যয় অজানা, প্রাইজমানি নিয়ে প্রশ্ন
জব্বারের বলীখেলায় তাঁরা ‘যুদ্ধ’ করতে ছুটে আসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। বালুর তৈরি ২০ ফুট বাই ২০ ফুটের মঞ্চে চলে হার না মানা লড়াই। সূর্যের প্রখর তাপ, শরীর বেয়ে চুয়ে পড়া ঘাম কিংবা প্রতিপক্ষের হুঙ্কার— কিছুই থামাতে পারে না। এই শক্তির যুদ্ধে কেউ জিতেন, আবার কেউ হারেন। নামের অগ্রভাগে যোগ হয় ‘চ্যাম্পিয়ন’ শব্দটি। আর দেশজুড়ে পান পরিচিতি —মনের স্বস্তি শুধু এটুকুই। এমন গল্প চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আবদুল জব্বারের বলীখেলায় অংশ নেওয়া বলীদের।
১৯০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখেলা নিয়ে চট্টগ্রামবাসীর অহংকারের শেষ নেই। দেশজুড়ে কত শত উচ্ছ্বাস! গণমাধ্যমে বিশেষ উত্তাপ, বিশেষ আয়োজন। করপোরেট হাউসগুলোর রঙছটা বিজ্ঞাপনসহ আরো কত কী! কিন্তু যাঁদের ঘিরে এত আয়োজন, সেই বলীরা বরাবরই রয়ে যান উপেক্ষিত। তারা কি পান প্রাপ্য সম্মান? এখানে খেলাটি মুখ্য, নাকি নেপথ্যে অন্য কিছু? —সম্প্রতি বলীখেলার ১১৫তম আয়োজন শেষে এমন প্রশ্ন ওঠেছে বিভিন্ন মহলে। ট্রল হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঐতিহাসিক এই বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা ঘিরে কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই। নেই কিছু লিখিতও। সব হিসাব-নিকাশ যেন অদৃশ্য। সংশ্লিষ্ট সবার কাছেই অজানা। যে যার মতো করেন আয়, আবার খরচও করেন নিজের মতো। এভাবেই চলে আসছে দীর্ঘ বছর।
এদিকে, প্রতিবছরই বলীখেলাকে ঘিরে বসে ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। যে মেলায় লালদিঘী-কোতোয়ালীর আশেপাশের চার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অস্থায়ী দোকান বসান দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ পণ্যের মেলাও এটি। কিন্তু এই মেলা ঘিরে চলে নানা ধরনের টানা চাঁদাবাজি।
অনুসন্ধান বলছে— প্রতি দোকান থেকে ‘ভাগের টাকা’ নেয় পুলিশও। যদিও মেলা শুরুর আগে এবং চলাকালীন সময়ে মাইকে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে কাউকে চাঁদা না দেওয়ার ‘হাঁকডাক’ কানে আসে। কিন্তু দোকানিরা আসা শুরু করতেই পুরোপুরি পাল্টে যায় বাস্তব চিত্র। ফলে, ঐতিহ্যবাহী এই মেলা এবং খেলা— দুটোর আয়োজনই হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ।
দর্শকরা বলছেন— পাড়ার ছোট ক্রিকেট টুর্নামেন্টেও যেখানে চ্যাম্পিয়নকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়, সেখানে বলীখেলার মতো ঐতিহ্যবাহী একটি আয়োজনে মাত্র ৩০ হাজার টাকা পুরস্কার খুবই নগণ্য। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়ারও কষ্ট পেতে হয়। যে আয়োজনে চট্টগ্রামের এত গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকেন; সেই আয়োজনে পুরস্কার (প্রাইজমানি) কীভাবে এত কম হয়—এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
নগণ্য প্রাইজমানি, হারাচ্ছে জৌলুস—
১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বকশিরহাটের স্থানীয় ধনী বণিক বদরপাতি এলাকার বাসিন্দা আবদুল জব্বার সওদাগর এই কুস্তি প্রতিযোগিতার সূচনা করেন। পরে তাঁর নাম অনুসারে এই আয়োজনের নামকরণ হয়েছে। মহামারি করোনায় দুই বছর (২০২০-২০২১) বাদে প্রতিবছরই নগরের লালদিঘী মাঠে আয়োজন হয় এই খেলার। যা এখন দেশের বৃহত্তম বার্ষিক লোক উৎসব হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ বলীখেলা অনুষ্ঠিত হয়।
এবারের ১১৫তম আসরে চ্যাম্পিয়নের জন্য বরাদ্দ ছিল ট্রফিসহ ৩০ হাজার টাকা। এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অধিকারীরা ট্রফির সঙ্গে পেয়েছেন যথাক্রমে ২০ হাজার, ১০ হাজার ও ৫ হাজার টাকা। অংশগ্রহণকারী ১০০ জনের মধ্যে ৫০ রাউন্ড খেলা হয়। সেই ৫০ রাউন্ডে বিজয়ীদের দুই হাজার টাকা করে পুরস্কার দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালে বলীখেলার ১১৪তম আসরেও চ্যাম্পিয়নকে ক্রেস্ট ও নগদ ৩০ হাজার টাকা এবং রানার্সআপকে ক্রেস্ট ও নগদ ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়।
এর আগে, ২০২২ সালের ১১৩তম আয়োজনে চ্যাম্পিয়নকে ২৫ হাজার টাকা ও ট্রফি; আর রানার্সআপ বলীকে দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার টাকা।
যদিও, ২০১৭ সালে অর্থাৎ ১০৮ তম আসরে এবং তার আগের সব আয়োজনে চ্যাম্পিয়নকে ট্রফি-ক্রেস্টসহ ২০ হাজার টাকা এবং রানার্সআপ বলীকে দেওয়া হতো ১৫ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট।
যা ২০২৩ ও ২০২৪ বেড়ে সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন মানি ৩০ হাজার টাকা করা হয়েছে। কিন্তু ১১৫তম আসরের পর চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপের উপহার হিসেবে দেওয়া এই প্রাইজমানি নিয়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের দর্শকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এত পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী একটি আয়োজনে এই নগণ্য পুরস্কার দেওয়ায় বলীখেলার মতো বড় একটি আয়োজন জৌলুস হারাচ্ছে— এমন দাবি অনেকের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও হচ্ছে এ নিয়ে নানা ট্রল।