টাঙ্গাইলে কৃষিযন্ত্র বিতরণে অনিয়ম, যন্ত্রপ্রতি কৃষি কর্মকর্তা নেন লাখ টাকা
টাঙ্গাইলে সরকারি ভর্তুকিমূল্যে দেওয়া বিভিন্ন কৃষি যন্ত্র (মেশিন) কৃষকদের মাঝে বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রকৃত কৃষকদের না দিয়ে এসব যন্ত্র দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তি, দালালদের।
এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির লোকের নামেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এসব কৃষিযন্ত্র। আর এসব কিছুর মূলে রয়েছেন খোদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। তার স্বাক্ষরেই সরকারের ভতুর্কির টাকা উত্তোলন করতে পারে মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ জন্য কৃষি কর্মকর্তাকে প্রতি হারভেস্টারে দিতে হয় নগদ এক লাখ টাকা।
তবে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, সারা বাংলাদেশেই একই চিত্র। আমি টাকা নিলে সমস্যা কি। এই টাকাটা কোম্পানি তার মতো অনেককেই অনারিয়াম দিয়ে থাকে।
জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় ভর্তুকিমূল্যে কৃষি যন্ত্র কম্বাইন হারভেস্টার ১৬টি এবং মেইজ শেলার বিতরণ করা হয়েছে ৫টি। এর মধ্যে টাঙ্গাইল পৌর এলাকায়ই ৯টি, ঘারিন্দা ইউনিয়নে তিনটি, গালা ইউনিয়নে তিনটি, করটিয়ায় দুইটি, মাহমুদনগরে দুইটি, বাঘিল ও ছিলিমপুরে একটি করে মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। তবে এসব বেশিরভাগ মেশিনের কোনো হদিস নেই।
এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে নতুন করে টাঙ্গাইলে ১৫ জন কৃষকের মাঝে কৃষি যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির ১০টি হারভেস্টার, তিনটি রাইস ট্রান্সপ্লান্টার এবং দুইটি রিপার বাইন্ডার।
এরমধ্যে গত ২৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের উত্তর হুগড়া গ্রামের মৃত মোবারক আলী সরকারের ছেলে মৎস্যজীবী লীগের নেতা মো. আমিরুল ইসলামকে আদি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডকে কম্বাইন হারভেস্টার দেওয়া হয় সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে। এতে সরকারি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা আমিরুল ইসলামকে পরিশোধের শর্ত দেওয়া হয়েছে। আমিরুলের বাড়িতে গিয়ে মেশিনের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে আমিরুল জানান, মেশিনটি তিনি নেননি। মেশিনটি তার ভাই নিয়েছেন এবং তার ভাইয়ের কাছেই মেশিনটি রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করলে প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা করার হুমকি দেন তিনি।
এবছর গালা ইউনিয়নেও চারটি এবং টাঙ্গাইল পৌর এলাকায় পাঁচটি কৃষি যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এরমধ্যে গালা ইউনিয়নের সদুল্যাপুর এলাকায় মজনু আহমেদ, রাবনা এলাকার আল আমিন এবং পৌর এলাকার এনায়েতপুরের মোঃ তোফাজ্জল হোসেন বাবুর নামে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব মেশিনে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা। তবে এদের কারো বাড়িতেই রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের হদিস পাওয়া যায়নি।
তবে মজনু মিয়া এবং তোফাজ্জল হোসেন বাবু জানান, তারা কয়েকজন পাটনার আছেন। তারা চারটি মেশিন পেয়েছেন। এসব মেশিন এনায়েত হোসেন বাবু নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে টাঙ্গাইল পৌরসভার তিন নং ওয়ার্ডের পশ্চিম আকুরটাকুর পাড়া এলাকার মোঃ নূর আবু নিশাত। তিনি চাকরি করেন কৃষিবিদ এগ্রিকালচার লিমিটেড কোম্পানিতে। তার নামেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রিপার বাইন্ডার। আর এ মেশিনে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে দুই লাখ টাকা। এছাড়া কাগমারা এলাকার সুনিল চন্দ্র দাসের নামেও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে রিপার বাইন্ডার। তাকেও দুই লাখ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, কোম্পানির লোক এসে তার কাছ থেকে মেশিন নিয়ে গেছে। বিনিময়ে তাকে অল্প কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কৃষিযন্ত্র সরবরাহের আগেই কৃষকের সাথে কৃষি অধিদপ্তরের একটি চুক্তিপত্র করতে হয়। ওই চুক্তিপত্রে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ তিনজন এবং কৃষকের পক্ষে তিনজন সাক্ষীর স্বাক্ষরের পর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্বাক্ষর করে মেশিন সরবরাহ করার কথা।
কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিতরণে অনিয়ম বড় ধরনের। একটি মেশিনে দুই লাখ থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দেয় সরকার। কৃষি কর্মকর্তা তার পছন্দের কৃষক নির্বাচন করে কৃষক ও কৃষিকর্মকর্তা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে ডাউন পেমেন্ট ৮লাখ টাকা দিয়ে মেশিন এনে কৃষককে বুঝিয়ে দেন। কৃষকের প্রাপ্তি স্বীকার নিয়ে কোম্পানি সরকারের ভর্তুকির টাকা আবেদন করে আদায় করে থাকে। এরপরে কৃষিকর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে ওই মেশিন বিক্রি করে টাকা ভাগাভাগি করে নেন দুই পক্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কৃষি কর্মকর্তা জানান, যারা মেশিনের জন্য আবেদন করেন তাদের মেশিন দেওয়া হয় ঠিকই। কিন্তু কেউ মেশিন নিয়ে কাজে লাগান আবার কোম্পানির লোকজন এই মেশিন দিয়ে ব্যবসা করেন। এ নিয়ে অডিট শুরু হলে কোনো কৃষকের বাড়িতে মেশিন না থাকলে কোম্পানির লোকজন ওই কৃষকের বাড়িতে লোবেট ভাড়া করে মেশিন পাঠিয়ে দেন। অডিট চলে গেলে আবার মেশিনটি ফিরিয়ে নিয়ে আসে কোম্পানির লোকজন। বিনিময়ে ওই কৃষককে দেওয়া হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। আবার এই একই মেশিন শুধু নাম্বার প্লেট পরিবর্তন করে অন্য কৃষকের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শুধু অডিট টিমকে দেখানোর জন্য। এভাবেই একটি মেশিন বারবার দেখানো হয় অডিট টিমকে।