চট্টগ্রামস্বাস্থ্য

ডাক্তার-বিশেষজ্ঞ কেউ নেই, প্রাণ যায় যায়

মুখে মাস্ক লাগিয়ে মায়ের হাত ধরে হাসপাতালের বিছানায় বসা সাফা মারওয়া। ম্যালিগন্যান্ট টিউমার নিয়ে গত চার মাস ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগে ভর্তি ৫ বছরের সাফা। তার পাশের বিছানায় ৮ বছর বয়সী আবির। মাস দুয়েক আগে তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ৬ দিন পর তার ধরা পড়ে ব্লাড ক্যান্সার। এপ্রিলের ৪ তারিখ থেকে আবিরও এখানে।

শুধু আবির, সাফা নয় ক্যান্সার ও থ্যালেসেমিয়া আক্রান্ত ১৮ ভর্তি শিশু এ বিভাগে। যাওয়া আসা করে চিকিৎসা নেয় ক্যান্সারে আক্রান্ত আরো ২৫০ শিশু। গত এক মাস ধরে ‘অনিশ্চয়তায়’ ওদের জীবন। বিভাগটিতে একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন অধ্যাপক ডা. এ কে এম রেজাউল করিম। তাঁর অবসরের পরে ‘জোড়াতালি’ চিকিৎসা চলছে বিভাগটিতে। হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞরা চালিয়ে নিচ্ছেন ‘শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের’ কাজ। গত এক মাসে ব্লাড ক্যান্সারে চার শিশুরও মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। শিশুদের এমন জীবন-মরণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বারংবার তাগাদায়ও সাড়া ভ্রুক্ষেপ নেই মন্ত্রণালয়ের।

চমেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে অধ্যাপক ডা. এ কে এম রেজাউল করিম বিএসএমএমইউ থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে একমাত্র শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যোগ দেন। গত ১০ বছরে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও দুইজন সহকারী অধ্যাপকসহ শূন্য থাকা চারটি পদের দায়িত্ব একাই সামলেছেন ডা. রেজাউল। তাঁর তত্ত্বাবধানে ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৪৪ জন ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ২৮ এপ্রিল অবসরোত্তর ছুটিতে চলে যান এই চিকিৎসক। এরপর থেকেই ‘জোড়াতালি’ দিয়ে চলছে বিভাগটি। হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসকরা আক্রান্ত রোগীদের ‘চলতি’ চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন।

এর আগে গত ৪ মার্চে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ তানভীর আহাম্মেদকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদায়ন করা হলেও এখনো যোগদান করেন নি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক চলে যাওবার পর গত এক মাসে চারজন ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে সাতকানিয়া উপজেলার ১২ বছর বয়সী তাফসির, কক্সবাজারের ৯ বছর বয়সী সাফা মারওয়া, ৮ বছরের উম্মে হাবিবা ও একই বয়সী শাহীন নামের এক শিশু। সপ্তাহের ব্যবধানে একে তাদের মৃত্যু হয়। অভিভাবকদের অভিযোগ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে ‘যথাযথ’ চিকিৎসা সেবা মিলেনি। মাহতাব নামের আরেক শিশু হাসপাতালের আইসিউতে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বলছেন তাঁরা।

তবে চার শিশুর মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে মৃত্যু তা মানতে নারাজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, শিক্ষক সংকটের বিষয়টি নিয়ে গত ২১ এপ্রিল মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। একইসঙ্গে সদ্য যোগদানকৃত চমেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিনও কয়েকদফা জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিদের। অথচ এখনো পর্যন্ত নড়চড় নেই।

অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে পদের অতিরিক্ত জনবল রয়েছে। কেউ কেউ ওসডি হয়ে সংযুক্ত হয়ে আছেন এই দুই মেডিকেলে। মন্ত্রণালয় চাইলে কিন্তু তাদেরকে এখানে পাঠাতে পারেন। এখানে অন্তত একজন বিশেষজ্ঞ অবশ্যই দরকার। কারণ এটা বিশেষায়িত সেবা। সার্বক্ষণিক নজরদারির ভেতরে রাখতে হয়। যখন তখন রোগীর ক্রিটিকাল অবস্থা হতে পারে। আমাদের চারটা পদ খালি। শত শত ক্যান্সার আক্রান্ত অসহায় শিশুদের জন্য ৪ জন না হোক, অন্তত ২ জন এখানে দেওয়া যেত।’

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. জেবীন চৌধুরী বলেন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘এটা সুপার স্পেশালিটি ডিপার্টমেন্ট। বিশেষজ্ঞ না থাকলে এখানে আমরা যা দেখবো সেটা কখনোই পর্যাপ্ত হবে না। আমরা চলতি চিকিৎসাগুলো চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখান থেকে দুইজন ডাক্তার প্রতিদিন রাউন্ড দিচ্ছেন। এখনো পর্যন্ত যেকোনো সমস্যায় রেজা স্যারকে ফোনে-ভিডিও কলে পাচ্ছি। কিন্তু সেটাও আর কতক্ষণ। অবসরে চলে যাওয়ার পর এটা তো নিয়মিত উনার কাছ থেকে আশা করতে পারি না। এটা তো সমাধান না।’

নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের এই বিভাগীয় প্রধান বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো সিদ্ধান্তের বিষয় থাকে। হুট করে কোনো একজন রোগীর ক্রিটিকাল অবস্থা হয়ে গেলো তখন আমরা কী করবো? আমরা তো এই বিষয়ের অভিজ্ঞ না। এখন যেভাবে চলছে সেটা জোড়াতালি দিয়ে। এখানে সার্বক্ষণিক একজন বিশেষজ্ঞের খুব দরকার। আমাদের এখানে ১৮টা বেড আছে। সবসময়ই ফিলআপ থাকে। আউটডোরে (বর্হিবিভাগ) প্রতিদিন ফলোআপে আসে প্রায় ১৫ জনের বেশি রোগী। ২৫০ জন রোগী চলমান চিকিৎসাধীন আছেন। যারা বিভিন্ন সময়ে এসে চিকিৎসা নিয়ে যান।’

একই প্রসঙ্গে সদ্য অবসরে যাওয়া শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘ক্যান্সার মানেই ক্রিটিকাল। বেশিরভাগই গরীব মানুষ। তাদের শেষ ভরসা এই চমেক হাসপাতাল। এখানে খুব তাড়াতাড়ি একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞকে পদায়ন করা হোক। বাংলাদেশের যেখানে অতিরিক্ত লোক আছে সেখান থেকে কোনো একজন এনে এখানে যত দ্রুত পদায়ন করা যায় ততই ভালো।’

জানতে চাইলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি, আমরা চিঠি দিয়েছি। বারবার তাগাদা দিচ্ছি যাতে একজন বিশেষজ্ঞ এখানে দেন। দুই মাস আগে একজন ডাক্তারকে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খবর পেয়েছি উনি দেশের বাইরে গেছেন আর ফিরবেন না। মন্ত্রণালয়কে বারবার রিমান্ডার দিচ্ছি।’

এদিকে, ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসায় দরকার তিনটি সুবিধা—কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও অস্ত্রোপচার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ছাড়া এসব সুবিধা আর কোনো সরকারি হাসপাতালে নেই। ঢাকার বাইরে কিছুটা সুবিধা আছে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর সেই সুবিধাও হারাতে বসেছে শুধুমাত্র একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে।

অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে জানিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত মো. আবিরের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘বাঁশখালী থেকে আসছি। আমার এই একটা ছেলে। কোনোরকমে দিন কাটে আমাদের। ক্যান্সার কি আমাদের মতো গরীব মানুষদের পাইছে? বড় ডাক্তার নাই। ছেলেটার যদি কিছু একটা হয়ে যায় আমরা বাঁচবো কীভাবে!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *