আন্তর্জাতিক

দুই যুদ্ধ জাহাজের উদ্ধার চেষ্টা ব্যর্থ

ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে ছিনতাইয়ের শিকার চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে উদ্ধার করা হয়েছে— এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতের প্রথম সারির কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। তবে এসব সংবাদের ভিত্তি তো নেই বরং উল্টো জিম্মি নাবিকরা এই সংবাদ দেখে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন; মনোবল হারাচ্ছেন। দুই যুদ্ধ জাহাজের উদ্ধার চেষ্টা ব্যর্থ

শনিবার (১৬ মার্চ) রাতে জিম্মি এক নাবিক অডিও রেকর্ড পাঠিয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন মার্চেন্ট নেভির ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খানকে।

ওই অডিও রেকর্ডে নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে জিম্মি নাবিক জানান, তারা সবাই সুস্থ এবং সোমালিয়ার জলদস্যুদের অধীনেই আছেন। ভারতীয় নৌবাহিনী তাদেরকে (নাবিক) উদ্ধার করেছে, এই সংবাদের কোনো সত্যতা নেই। মিডিয়ায় এই সংবাদটা দেখে তারা (নাবিক) বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তারা (নাবিক) চান যেন মানুষ সত্যটা জানুক।

ওই রেকর্ডে আরও বলা হয়, ‘গতকাল (শুক্রবার) সকালে সোমালিয়ার কোস্টে অগ্রসর হওয়ার সময় ইউরোপ আর ভারতীয় দুটি নেভির যুদ্ধ জাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যুদের থামতে বলেছে, ওয়ার্নিং দিয়েছে, ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলেছে। এ সময় আশপাশে পানিতে গোলাগুলি করেছে। কিন্তু জলদস্যুরা নির্বিকার ছিল। এ সময় জলদস্যুরা মনে করেছিল বাংলাদেশের নাবিকরা ওদেরকে ডেকে এনেছে। তাই ওরা (দস্যু) কিছুটা রাগ করে সবাইকে ব্রিজে ডেকে বন্দুকের মুখে রেখেছিল। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন রেডিওতে ভারতীয় নেভিকে দূরে সরে যেতে বললে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়।’

দেশি গণমাধ্যমেও জলদস্যুদের নজর

একজন দোভাষী সর্বদা বাংলাদেশের মিডিয়ার ওপর নজর রাখছে উল্লেখ করে ওই নাবিক বলেন, ‘জলদস্যুদের যে দোভাষী সে বাংলাদেশের টিভি আর মিডিয়ার ওপর চোখ রেখেছে। তাই গুজব রটানো বা নাবিকরা বিপদে পড়ে— এমন কিছু যেন মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়ানো না হয়।’

জিম্মি হওয়ার পর এই প্রথম যোগাযোগহীন

এদিকে, জিম্মি হওয়ার দিন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে জাহাজের মালিকপক্ষ এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ করছিলেন বাংলাদেশি নাবিকরা। কিন্তু শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মার্চেন্ট নেভির ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খান কে পাঠানো অডিও বার্তা ছাড়া অন্য কোনো অডিওবার্তা কিংবা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কথা জানা যায়নি। এই প্রথম একটি দিনেরও বেশি পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন নাবিকরা।

জলদস্যুদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবি না করা হলেও ধারণা করা হচ্ছে, মালিকপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগেই জলদস্যুরা এই কৌশল অবলম্বন করছে। এদিকে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় জিম্মি নাবিকদের পরিবারের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে অজানা শঙ্কা।

মালিকপক্ষকে চাপ দিতে জলদস্যুদের কৌশল

নাবিকদের সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সাধারণ সম্পাদক মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘এমন বিচ্ছিন্নতা তৈরি করা জলদস্যুদের একটি কৌশল। চাপ বাড়াতে তারা এমনটি করে। এটা নিয়ে স্বজনদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। জলদস্যুরা মুক্তিপণের জন্য নিজ থেকেই যোগাযোগ করবে।’

জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, গত বৃহস্পতিবার জলদস্যুদের নতুন আরেকটি দল জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এটি উপকূল থেকে চার নটিক্যাল মাইল দূরে গিয়ে নোঙর করেছে। শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে জাহাজটি অবস্থান পাল্টে এখানে নোঙর ফেলে। জলদস্যুদের কেউ তাদের সঙ্গে এখনও মুক্তিপণের ব্যাপারে যোগাযোগ করেনি। তবে নাবিকেরা সবাই ভালো, সুস্থ আছেন।

এর আগে, গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় বেলা একটার দিকে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে। সশস্ত্র জলদস্যুরা মাত্র ১৫ মিনিটে ২৩ নাবিককে জিম্মি করে জাহাজটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। এর পর সোমালিয়া উপকূলের দিকে যাত্রা শুরু করে। বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে সোমালিয়ার গ্যারাকাড উপকূলে পৌঁছে জাহাজটি।

পরবর্তীতে সোমালিয়ার স্থানীয় সরকারের নির্দেশক্রমে এমভি আবদুল্লাহ শুক্রবার সকাল ১১টায় নোঙর তুলে স্থান পরিবর্তন করে বিকেল ৪টার দিকে আগের অবস্থান হতে ৪০ মাইল দূরে গিয়ে নোঙর করে। জাহাজের বিভিন্ন অবস্থানে মেশিনগান আর একে-৪৭সহ নিরাপত্তা প্রহরী বসায় জলদস্যুরা।

জাহাজে জিম্মি ২৩ নাবিকেরা হলেন—মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মো. শামসুদ্দিন, মো . আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর একই গ্রুপের এসআর শিপিং এর আরেকটি জাহাজও জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। সেই জাহাজের নাম জাহান মণি। ৪০ কোটি টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ১০০ দিনের মাথায় ওই জাহাজ থেকে মুক্তি পান ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *