চট্টগ্রাম

দুর্নীতি, ব্যর্থতা, এবং অপচয়ের গল্প: চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি ফজলুল্লাহর ১৪ বছর!

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম ফজলুল্লাহর দীর্ঘ ১৪ বছরের দায়িত্ব পালন এবং এর ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন বিতর্ক, অনিয়ম, ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।

ফজলুল্লাহ, যিনি আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ৮১ বছর বয়সী একজন প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম ওয়াসার উন্নয়ন ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও তার সময়ে নগরের পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। প্রকল্পগুলোর সময়মতো শেষ না হওয়া, ব্যয় বৃদ্ধি, পানি চুরি, এবং দুর্নীতির অভিযোগের কারণে তার নেতৃত্ব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে অনেক দিন ধরে।

এ কে এম ফজলুল্লাহ ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০০ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ফজলুল্লাহ প্রথমবার চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে এক বছরের জন্য নিয়োগ পান। এরপর, ২০১১ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ সৃষ্টি হলে, তিনি সেই পদে নিয়োগ পান এবং তারপর থেকে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

প্রকল্প নেওয়ার ধারা ও সময়মতো শেষ করতে না পারা

ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ওয়াসা অন্তত ১০টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে আটটি শেষ হয়েছে এবং দুটি এখনো চলমান রয়েছে। মোট প্রকল্পগুলোর ব্যয় ৮ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, এবং চলমান দুটি প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। তবে প্রকল্পগুলোর সময়মতো সমাপ্তি না হওয়া এবং বারবার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে এসব প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।

পানি সরবরাহ এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যাগুলো

ফজলুল্লাহর সময়ে নেওয়া প্রকল্পগুলো নগরে পানির সংকট কাটাতে সফল হয়নি। বর্তমানে, চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে, যার ৩০ শতাংশ পানি কারিগরি অপচয়ের কারণে নষ্ট হয়। ২০১৪ সালে পানি অপচয় কমানোর জন্য একটি প্রকল্প নেয়া হয়, যার ব্যয় ছিল ৪৫ কোটি টাকা। তবে, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও অপচয় কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০১৯ সালে অপচয়ের হার ছিল ২৫ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে ২৮ শতাংশে দাঁড়ায়।

দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ

ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ওঠে। ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে চট্টগ্রামের বাসিন্দা হাসান আলী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালকের কাছে অভিযোগ করেন। এর কিছুদিন পর, চট্টগ্রাম ওয়াসা ভবনের একটি কক্ষে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটে, যাতে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে যায়।

এছাড়া, ফজলুল্লাহর সময়ে ওয়াসায় নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। বিশেষ করে, গাড়িচালক মো. তাজুল ইসলাম, যিনি চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ১৩ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন, ফজলুল্লাহর প্রশ্রয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য চালিয়ে যান। তাজুল ইসলাম চট্টগ্রামে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন, যা নিয়ে দুদকেও মামলা হয়েছে।

এমডি ফজলুল্লাহ অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি দাবি করেন, তিনি কাউকে কোনো ধরনের প্রশ্রয় দেননি।

বিদেশ সফর ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বিতর্ক

ফজলুল্লাহর আমলে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিদেশ সফর ও প্রশিক্ষণ নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২২ সালের মে মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর সীমিত করার নির্দেশনার পরও ফজলুল্লাহ এবং চার কর্মকর্তা প্রশিক্ষণের নামে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। এছাড়া, ফজলুল্লাহর নেতৃত্বে ওয়াসার ৪১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী উগান্ডায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়, যা নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়।

বেতন বৃদ্ধির চেষ্টা এবং সমালোচনা

ফজলুল্লাহর বিরুদ্ধে বেতন বৃদ্ধির চেষ্টাও সমালোচনার কারণ হয়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি তার বেতন ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা থেকে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার আবেদন করেছিলেন। বোর্ড সদস্যরা এ আবেদনের পর বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফজলুল্লাহ তার আবেদন প্রত্যাহার করে নেন।

অগ্রগতি ছাড়া প্রকল্প এবং আর্থিক অপচয়

ফজলুল্লাহর সময়ে নেওয়া প্রকল্পগুলোর ধীরগতির কারণে নগরের পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অগ্রগতি থেমে আছে। ২০১৮ সাল থেকে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকার একটি পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পে মাত্র ৫৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্পের সময়সীমা বারবার পেছানো হচ্ছে এবং ব্যয়ও বাড়ছে। এছাড়া, ফজলুল্লাহর সময়ে নেওয়া চারটি বড় পানি সরবরাহ প্রকল্পের মধ্যে কোনোটিই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি এবং দুটি প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ১ হাজার ৭১২ কোটি টাকা।

ফজলুল্লাহর দীর্ঘ ১৪ বছরের নেতৃত্ব চট্টগ্রাম ওয়াসার জন্য একটি মিশ্র অভিজ্ঞতা তৈরি করেছে। তার আমলে নেয়া প্রকল্পগুলোর ধীরগতি, ব্যয় বৃদ্ধি, এবং বিভিন্ন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ চট্টগ্রাম ওয়াসার কার্যক্রম নিয়ে জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে।

প্রকল্পের ধীরগতির জন্য এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতাকে দায়ী করলেও সনাক-টিআইবির চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি আখতার কবির চৌধুরীর মতে, ফজলুল্লাহর সম্পদ এবং প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত করা উচিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফজলুল্লাহর নেতৃত্বের মেয়াদ চট্টগ্রাম ওয়াসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ ও বিতর্ক একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করেছে। জনস্বার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যক্রমের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির বিষয়ে গভীর তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *