চট্টগ্রাম

দূষণে সংকটাপন্ন জীববৈচিত্র্য

৭৯ স্থানে কর্ণফুলী নদী দূষণের চিত্র দেখেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এর মধ্যে ৭৭ স্থানে রয়েছে ভয়াবহ দূষণ। শিল্প, পয়োবর্জ্য, পলিথিনসহ রাসায়নিক-কঠিন ও তরল বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। দূষণে ঝুঁকিতে রয়েছে জীববৈচিত্র্য। নদী কমিশনের সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া যায়। সমীক্ষাটি বলছে, ৭৭ স্থানের মধ্যে নগরীর ২৩ স্থানে দূষণ রয়েছে। ১৯টি খালের মাধ্যমে গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানা, ডায়িং মিলের তরল ও কঠিন বর্জ্য সরাসরি পড়ছে কর্ণফুলীতে। এছাড়াও জেলার রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী উপজেলায় ব্যাপক দূষণ রয়েছে। পরিবেশ আইন প্রয়োগে নদীদূষণ বন্ধ করার সুপারিশ করেছেন সমীক্ষাদলের সদস্যরা।

সমীক্ষাটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নগরীর শিল্পজোন এলাকা ও জেলার কর্ণফুলী উপজেলায় নদী ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে। কর্ণফুলী উপজেলায় দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন শিল্প-কারখানা থেকে মারাত্মক দূষণ ছড়াচ্ছে। সিমেন্ট, চিনি উৎপাদনকারী শিল্প, ফিশিং কমপ্লেক্স, তেল পরিশোধন কারখানার বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গৃহস্থালি, শিল্প-কারখানা, ডায়িং কারখানার বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে নদীতে। নগরীর বিভিন্ন স্থানে নদীর তীরে গড়ে ওঠা তেলের দোকান, খোলা টয়লেট, সার কারখানা, সিমেন্ট কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকার শিল্প-প্রতিষ্ঠানের কেমিক্যাল বর্জ্য ড্রেন ও খালের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে নদীতে। এছাড়াও কৃষি কাজে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার খালের মাধ্যমে নদীতে মিশছে। দূষণের কারণে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের উপক‚লীয় নদ-নদীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর তলদেশের মাটি, পানি, মাছ ও উদ্ভিদের ক্ষতি ছাড়াও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

২০১৬ সালে কর্ণফুলীর দখল-দূষণ নিয়ে জরিপ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। তাতে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীতে মিঠাপানির ৬৬ প্রজাতির এবং মিশ্রপানির ৫৯ প্রজাতির ও সামুদ্রিক ১৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো। মিঠাপানির ২০-২৫ প্রজাতির ও মিশ্রপানির ১০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। ১০-২০ প্রজাতির মাছ ছাড়া অন্য প্রজাতির মাছ বিপদাপন্ন। এখনও মাঝে মাঝে কর্ণফুলী নদীতে ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়।

নদীর পাড়ে এবং আশেপাশে গড়ে ওঠা ৩০০-৪০০টি ছোট-বড় কল-কারখানার বর্জ্যসহ নগরীর কঠিন বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ফেলার কারণে কর্ণফুলীর বাস্তুসংস্থান বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি নদীর পরিবেশও হুমকির মুখে পড়েছে। ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্প না থাকায় নগরবাসীর মানবসৃষ্ট ও গৃহস্থালি এবং পয়োবর্জ্যসহ প্রায় ১৫-২০ কোটি লিটার বর্জ্য নদীতে পতিত হচ্ছে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা বলছে, কর্ণফুলী নদীতে একসময় বেলে, কাঁচকি, চান্দা, পুটি, বাচা, চেলা, বড় ইচা, গুঁড়া চিংড়ি পাওয়া যেতো। আইড়, কালিবাউশ, কাতল, রুই, মৃগেল, বোয়াল, ফলই, পাঙ্গাস, নাইলোটিকা, গলদা, চিংড়ি, ছোট হরিণা চিংড়ি মাঝে মাঝে পাওয়া যেতো। ২০ বছর আগে বাবমি, চিতল, কাঁচকুড়ি, পারশে ও বাঁশপাতা মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন আর পাওয়া যায় না।

নির্বিচারে মৎস্য আহরণ, কারেন্ট জাল, ছোট ফাঁস জালের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং দূষণের কারণে মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ কমে যাচ্ছে। নদীতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের স্বীকৃত স্থান বা মৎস্য অভয়াশ্রম না থাকায় অনেক মাছ প্রজননের অভাবে হারিয়ে গেছে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *