চট্টগ্রাম

নকল ‘হ্যালোথেন’ দিয়ে অজ্ঞান, ফিরে না জ্ঞান

ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ এনে প্রায়ই হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভাঙচুর ও চিকিৎসকদের লাঞ্ছিত করা হয়। ভুক্তভোগীরা কখনও করেন মামলা, কখনও চিকিৎসাসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয় ক্ষতিপূরণ।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ অভিযোগ আসে অপারেশনের রোগীর মৃত্যুতে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরাও এতে অবাক হন।

সব নিয়ম মেনে অপারেশন করার পরও এমন ঘটনা ঘটলে বিষয়টিকে ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

অথচ অ্যানেসথেসিয়ার জটিলতায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে-এ তথ্য ছিল অজানা। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ঘটনায় বিষয়টি সামনে এসেছে। রোগীর অপারেশনের আগে অজ্ঞান করার ওষুধ ‘হ্যালোথেন’ নকল হয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা। ফলে নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলেও ফিরছে না রোগীর জ্ঞান।

বাংলাদেশে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালস হ্যালোসিন ব্র্যান্ড এর নামে হ্যালোথেন উৎপাদন করতো। এই হ্যালোথেনের ক্ষতিকর শারীরিক ও পরিবেশগত প্রভাবের কারণে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এটি নিষিদ্ধ করে। এরই প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে দেশে উৎপাদন বন্ধ করা হয়। তবে কিছু হাসপাতালে আগের সংগ্রহ করা হ্যালোথেন মজুত ছিল। এছাড়া চাহিদা থাকায় নকল হ্যালোথেন বাজারে ছড়িয়ে দেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা।

গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ও হাসপাতাল প্রতিনিধিদের বৈঠকে ‘হ্যালোথেন’ ব্যবহার না করার নির্দেশনা আসে।

সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের প্রতি কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে ‘হ্যালোথেন’ ওষুধ ব্যবহারে নিষেধ করা হয়েছে। হ্যালোথেনের বিপরীতে অন্য ওষুধ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ান (বিএসএ-সিসিপিপি) চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শরীফ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা পাওয়ার কথা জানান।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে ইনহেলেশনাল অ্যানেসথেটিক (নিশ্বাসের সঙ্গে যে চেতনানাশক নেওয়া হয়) হিসেবে হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ব্যবহার করতে হবে। সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট হ্যালোথেন/আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ভেপোরাইজারের সংখ্যা এবং বিদ্যমান হ্যালোথেন ভেপোরাইজার পরিবর্তন করে আইসোফ্লুরেন/সেভোফ্লুরেন ভেপোরাইজার প্রতিস্থাপন করতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রাক্কলন করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জারি করা অফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো অবস্থাতেই নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছাড়া চেম্বারে অথবা ডায়াগণস্টিক সেন্টারে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে না। বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ অ্যানেসথেটিস্ট ছাড়া যেকোনো ধরনের অপারেশন করা যাবে না।

জানা গেছে, দেশে প্রায় ২০ শতাংশ অপারেশন জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে করা হয়। বাকি ৮০ শতাংশ করা হয় অন্যান্য অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে। যে অপারেশন এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে, তাতে জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো ওষুধ প্রয়োগ করে অপারেশনের সময়সীমা বৃদ্ধি করা যায়। এর জন্য হ্যালোথেন বা সমগোত্রীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সূত্রে জানা গেছে, মেশিনের দাম বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিকল্প চেতনানাশক ভেপোরাইজার থাকে না। দেশে ২০০ এমএল হ্যালোসিনের দাম ১৪শ-১৫শ টাকা। এর বিকল্প আইসোফ্লুরেনের দাম ৩ হাজার এবং সেভোফ্লুরেনের দাম ১২ হাজার টাকা। নকল হ্যালোথেন নিয়ে দেরিতে পদক্ষেপের কারণে অ্যানেসথেসিয়া সংক্রান্ত জটিলতা এবং মৃত্যু বৃদ্ধি পেয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *