চট্টগ্রাম

নগরীতে ‘শিশু নিখোঁজ’ আতঙ্ক

গেলো ২১ জুন সন্ধ্যায় নগরীর হালিশহর এলাকার নিজ বাসা থেকে নিখোঁজ হয় ১৩ বছর বয়সী আব্দুল মুনঈম ফুয়াদ। তাকে বাসায় না পেয়েই স্বজনরা চট্টগ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে শিশুটির নিখোঁজ জানিয়ে পোস্ট করতে থাকেন।

ওইদিনই ‘হেল্প ইন চট্টগ্রাম’ নামের একটি গ্রুপে পোস্ট করেন শিশুটির দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় সাজ্জাদ ভূঁইয়া। তবে পরদিন শিশুটিকে পাওয়া গেলেও তিনি সেই তথ্য আর জানাননি। এ বিষয়ে সাজ্জাদ ভূঁইয়া জানান, মা বকা দেওয়ায় আব্দুল মুনঈম ফুয়াদ মূলত বাসা থেকে রাগ করে মিরসরাইয়ে দাদুর বাড়িতে চলে গিয়েছিল। পরদিন আবার চলে এসেছে।

এর আগে ৮ জুৃন সকালে চান্দগাঁও এলাকায় আরাকান সড়কের একটি মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজ হয় ৯ বছর বয়সী শাওয়াল শরীফ সাদমান। তার নিখোঁজের বিষয়টি জানাজানি হলে স্বজনরা ফেসবুকে চট্টগ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করতে থাকেন। এ ঘটনায় আরাফাত উদ্দিন নামের একজন ‘ডেসপারেটলি সিকিং চট্টগ্রাম’ নামের গ্রুপে পোস্ট করে শিশুটির সন্ধান চান। তবে ওইদিন রাতেই শিশুটিকে পাওয়া গেলেও তিনি সেই তথ্য আর জানাননি।

ওই শিশুর মামা কামরুল মোস্তফা মানিক বলেন, মূলত ওইদিন সকালে তাকে মাদ্রাসায় দিয়ে আসে বাবা। মাদ্রাসার মূল ফটকের ভেতরে বাচ্চাটাকে পৌঁছে দিলেও তিনি সরাসরি শ্রেণিক্ষে পৌঁছে দেননি। ওর বাবা ফিরে আসার সময় বাচ্চাটাও পিছন পিছন চলে আসে, পরে হারিয়ে যায়। দুুপুরে নিখোঁজের ঘটনাটি জানাজানি হয়, পরে সন্ধ্যায় কাতালগঞ্জ এলাকার একটি দোকান থেকে বাসায় ফোন দিলে সেখান থেকে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।

গেলো মঙ্গলবার চান্দগাঁওয়ের পাঠানিয়া গোদা এলাকায়ও অনেকটা একইরকম আরেকটা ঘটনা ঘটে। পড়াশোনা নিয়ে মারধর করায় ওইদিন রাত নয়টায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় ১২ বছর বয়সী সাকিব হোসেন মারুফ। এই ঘটনাও শিশুটির স্বজনরা চট্টগ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করতে থাকেন। তবে পরদিন সকালে ফিরে আসে শিশুটি।

সাকিব হোসেন মারুফের মা সাফিয়া খাতুন বলেন, মারুফ পড়াশোনা না করে দুষ্টুমি করার কারণে আমি একটা থাপ্পড় দিয়েছিলাম। এই কারণে সে বাসা থেকে বের হয়ে সিটি এলাকায় বোনের শ্বশুরবাড়িতে চলে গিয়েছিল। তবে সেখানে কেউ ছিল না, তাই সারারাত সেখানে দরজার বাইরে বসে কাটিয়ে দিয়েছে। পরে বুধবার বাসায় ফিরে এসেছে।

গেলো মার্চ থেকে চট্টগ্রাম ভিত্তিক বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ পর্যালোচনা করে এরকম অন্তত ৩০টি নিখোঁজ সংবাদ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া পরবর্তীতে প্রায় সবাইকেই পাওয়া গেছে। এমনকি এসব ঘটনার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য না জানানোয় খুঁজে পাওয়ার পরও ফেসবুকে থাকা নিখোঁজ সংবাদ ব্যবহারকারীদের অনবরত শেয়ার করতে দেখা গেছে।

এদিকে ব্যতিক্রম চট্টগ্রাম নগরীর হামজারবাগ এলাকার মোঃ জহিরুল ইসলাম জহির, গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় তার ভাইয়ের ছেলে হারানো গিয়েছে বলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রুপে রাত ১টার দিকে পোস্ট করতে থাকে, ঘন্টা খানেকের মধ্যে পোস্টটি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ার পর, পোস্ট আপডেট ও কমেন্টস এর মাধ্যমে জানাই, হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের ছেলেকে পরিচিত একজন পেয়ে বাসায় এনে দিয়েছে।

ফেসবুকে পাওয়া নিখোঁজের এসব ঘটনার মধ্যে ৫টি সংবাদে দেওয়া মোবাইল নম্বরে গতকাল যোগাযোগ করলে তাদের সবাইকেই পরবর্তীতে পাওয়া গেছে বলে জানতে পারেন প্রতিবেদক। এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একের পর এক এমন নিখোঁজ সংবাদে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন অভিভাবকরা।

একের পর এমন ঘটনায় নাজমা হক নামের একজন শঙ্কার কথা জানিয়ে নিজের ব্যবহৃত ফেসবুক পেজে লিখেছেন, হঠাৎ করেই ছেলে-মেয়ে হারানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। বিষয়টি শঙ্কার। সবাইকে সাবধানে থাকার অনুরোধ করছি।

গতকাল বুধবার সাড়ে দশটার দিকে হেল্পলাইন চিটাগাং নামক গ্রুপে এমডি এমরান হোসাইন জয় নামের একজন লিখেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ জনের নিখোঁজ সংবাদ! চট্টগ্রামে এগুলো কী শুরু হলো হঠাৎ! একটানা এত ছেলে-মেয়ে নিখোঁজ।

এ বিষয়ে শিশুর অভিবাবকদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তৎপর হওয়ার পরামর্শ চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেনের। তিনি বলেন, হাতের আঙ্গুল কেটে গেলে আগে ব্যান্ডেজ না করে আমাদের ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তেমনি বাসার কোন শিশু বা অন্য কাউকে পাওয়া না গেলে সবকিছু বাদ দিয়ে সবাই ফেসবুকে পোস্ট করেন। এটা অনুচিত। এমনটা ঘটলে পারিবারিকভাবে আগে খোঁজ নিয়ে পুলিশকে জানানো উচিত। এসব ঘটনা খোঁজখবর না নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করলে অন্য ব্যবহারকারীরা আতঙ্কিত হতে পারেন।

এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আবার অনেক সময় ভয়ের সংস্কৃতির জন্য ফেসবুকে এভাবে মিথ্যা পোস্ট করে ভীতি তৈরি করা হয়। এটা অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য করে থাকেন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তৎপর হওয়া উচিত।

তবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) এ এস এম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, শিশুদের সঙ্গে বাবা মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা উচিত। সময়ের সঙ্গে শিশুর মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে, অভিভাবকদের সেটা বুঝতে হবে। এটা সামাজিক সমস্যা। আর যদি কোন বাচ্চা রাগ করে চলেও যায়, তারা ফেসবুকে পোস্ট না দিয়ে যদি স্বজনদের কাছে খোজাখুঁজি করে বা থানায় চলে যায়, তাহলে দ্রুত সমাধান হবে। ফেসবুকে পোস্ট দিলে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়।

তিনি আরও বলেন, তবে হ্যাঁ, ফেসবুকে পোস্ট দেবে; কিন্তু এটা সর্বশেষ অপশন হওয়ার কথা। এর চেয়ে ভালো আইনের আশ্রয় নেওয়া। তবে কেউ যদি ইচ্ছে করে এরকম মিথ্যা পোস্ট করে, তাহলে আমাদের মনিটরিং টিমের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *