পদোন্নতি ও বদলির হিড়িকে প্রশাসনে অস্থিরতা: কোথায় যাচ্ছে পরিস্থিতি?
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসনে দেখা দিয়েছে চরম অস্থিরতা। সচিব থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে বদলি এবং ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) হওয়ার আতঙ্ক। এদিকে, যারা এতদিন পদোন্নতি বা পদায়ন থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে। এই পরিস্থিতিই প্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি করেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ইতোমধ্যে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশত পদে রদবদল আনা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং মাঠ প্রশাসনেও পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে।
তবে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সিভিল সার্ভিসের ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে শুধুমাত্র প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অন্য ২৪টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা, যারা বিগত সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত বা নিগৃহীত হয়েছেন, তাদের বিষয়ে এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এদিকে, অতীতে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে চাপ সৃষ্টি করে পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন নিজেদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে, এমনকি সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরেও কর্মসূচি পালন করছেন। এই পরিস্থিতি প্রশাসনকে ব্যস্ত এবং অস্থির করে তুলেছে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে প্রশাসনে দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। একসঙ্গে সবকিছু করা সম্ভব নয়, তাই কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাইকে খুশি করতে গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, রাতারাতি কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
পদোন্নতি ও পদায়নের প্রতিযোগিতা
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে পুলিশ ও প্রশাসনের প্রায় ৬ শতাধিক কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকে একসঙ্গে দুই ধাপ পদোন্নতিও পেয়েছেন। ১৮ আগস্ট, ৭৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়, যেখানে ৩১ জন পুলিশ সুপার সরাসরি দুই ধাপ পদোন্নতি পেয়েছেন। গত দুই সপ্তাহে ৩৪০ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। সিনিয়র সহকারী সচিব পদে আটকে থাকা ১১৭ জনকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং ২৫৯ জন নতুন নিয়োগ পেয়েছেন।
অন্যদিকে, গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক থাকা অনেক কর্মকর্তার চুক্তি বাতিল হয়েছে। এক যুগ আগে অবসরে যাওয়া ৫ জন কর্মকর্তাকে সিনিয়র সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিতর্কিতদের পদোন্নতি
প্রশাসনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অনেক বিতর্কিত কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অতীতে গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা পদোন্নতি পেয়েছেন। যেমন, উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া আকবর আলী, এ এইচ এম আসিফ বিন ইকবাল এবং সেকেন্দার হায়াতের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার পর শাস্তি হয়েছিল, তবুও তারা পদোন্নতি পেয়েছেন।
বঞ্চিতদের অসন্তোষ
অনেক কর্মকর্তা, যারা বিগত সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছিলেন, তারা নতুন প্রশাসনেও তেমন গুরুত্ব পাচ্ছেন না। যেমন, ১৩তম বিসিএসের নাজমুল আমিন মজুমদার, যিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে খালেদা জিয়ার পিএস ছিলেন, তিনি পদোন্নতি পাননি। অন্যদিকে, ২৪তম ব্যাচের উপসচিব আবুল কালাম আজাদকে তার কর্মকাণ্ডের জন্য বদলি করা হয়েছে।
দাবি-দাওয়ার চাপে সচিবালয়ের নিরাপত্তা
সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে প্রতিদিন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর ফলে প্রশাসনের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেছেন, ‘নতুন সরকারকে সুস্থির থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। কর্মকর্তাদের বুঝতে হবে, তাদের বঞ্চনার জন্য এই সরকার দায়ী নয়। পদোন্নতি ও পদায়ন আরও ধীরেসুস্থে করা উচিত ছিল, তাহলে এমন অস্থিরতা তৈরি হতো না।’ তিনি আরও বলেন, সচিবালয়ের নিরাপত্তা রক্ষায় সেনাসদস্য মোতায়েনের প্রয়োজন হতে পারে।