পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতে মিলে যেসব ফজিলত
পবিত্র কোরআন একটি চিরন্তন, শাশ্বত, মহাগ্রন্থ ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস। এটি মহাসত্যের সন্ধানদাতা, সর্বশেষ ও সর্বাধুনিক ইলাহি কিতাব। এটি পৃথিবীর সব মানুষের জন্য জ্ঞান ও হেদায়াত লাভের উৎসমূল।
জ্ঞানবিজ্ঞান ও ইসলামি আইনকানুন সংক্রান্ত সব বিষয়ে পবিত্র কোরআনই চূড়ান্ত দলিল হিসেবে গৃহীত। এতেই মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সব অত্যাবশ্যকীয় বিষয় ও ঘটনার বিবরণ রয়েছে। কোরআন আল্লাহর কিতাব। এর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করা ইবাদত। এটি মানুষের যাবতীয় কল্যাণের উৎস। তার থেকে দূরে সরে যাওয়ার মাধ্যমেই মানুষ অকল্যাণে নিপতিত হয়।
কোরআনের মাধ্যমে বিবিধ কল্যাণের দ্বার উন্মোচিত হয়, যা একজন ব্যক্তিকে ক্রমাগত আরও কিছু অনুসন্ধান করার পথ দেখায়, যাতে সে এর মাধ্যমে উভয় জাহানে সম্মানিত হয়। আর কোরআন তেলাওয়াতকারীর উপর কল্যাণ বর্ষিত হয়। কেননা পবিত্র কোরআন পঠিত কোনো সাধারণ বইয়ের মতো নয়। এটি বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী। যা তিনি মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিকট গোটা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য নাজিল করেছেন। যেন এর মাধ্যমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পরিচালিত করেন।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, عَلَيْكُمْ بِالْقُرْآنِ، فَإِنَّهُ فَهْمُ الْعَقْلِ وَنُورُ الْحِكْمَةِ وَيَنَابِيْعُ الْعِلْمِ وَأَحْدَثُ الْكُتُبِ بِالرَّحْمَنِ عَهْدًا، وَقَالَ فِي التَّوْرَاةِ : يَا مُحَمَّدُ إِنِّي مُنَزِّلٌ عَلَيْكَ تَوْرَاةً حَدِيْثَةً تَفْتَحُ فِيْهَا أَعْيُنًا عُمْيًا وَآذَانًا صُمًّا وَقُلُوْبًا غُلْفًا- ‘তোমরা কোরআনকে আবশ্যক করে নাও। কেননা এটি বিবেকের খোরাক, প্রজ্ঞার আলোকমালা, জ্ঞানের প্রস্রবণ, আল্লাহর নাযিলকৃত কিতাবসমূহের মধ্যে সর্বাধুনিক। আর আল্লাহ তাওরাতে বলেন, হে মুহাম্মদ! আমি তোমার উপর সর্বাধুনিক কিতাব নাজিল করেছি। যা অন্ধের দৃষ্টিকে, বধিরের শ্রবণশক্তিকে এবং অনুভূতিশূন্য বদ্ধ হৃদয়ের বোধশক্তিকে উন্মোচিত করবে।
কোরআন (القرآن) শব্দের অর্থ পঠিত, তেলাওয়াতকৃত। যা সবকিছুকে শামিল করে। আর কোরআনকে ‘কোরআন’ এজন্যই বলা হয় যে, তাতে শুরু-শেষ, আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম, প্রতিশ্রুতি-ধমক, শিক্ষণীয় ঘটনাবলি, উপদেশ, দুনিয়া ও আখেরাতের সবকিছুর ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেইসঙ্গে রয়েছে আয়াতগুলির একে অপরের সঙ্গে অনন্য সমন্বয় ও সুসামঞ্জস্য। নিম্নে কোরআন শিক্ষার গুরুত্ব আলোকপাত করা হল।
কোরআন শিক্ষাগ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারী শ্রেষ্ঠ
সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ রয়েছেন। সকল শ্রেণি ও পেশার লোকদের চাইতে কোরআন শিক্ষাগ্রহণকারী ও শিক্ষাদানকারীগণ সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিগণিত। ওসমান (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন,خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে নিজে কোরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়’।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, إِنَّ أَفْضَلَكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কোরআন শিক্ষা করে ও অন্যকে শিখায়’। অতএব কোরআন নিয়মিত তেলাওয়াত করতে হবে এবং এর সঠিক মর্ম অনুধাবন করে তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে হবে। উহুদ যুদ্ধের শহীদগণের একাধিক ব্যক্তিকে একই কবরে দাফন করা হয়। আর সর্বোচ্চ কোরআন হিফজকারীকে রাসূল (সা.) আগে কবরে নামানোর নির্দেশ দিলেন।
যেমন জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,- ‘নবী করীম (সা.) উহুদ যুদ্ধের শহীদগণের দু’জনকে একই কাপড়ে একত্রিত করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এদের মধ্যে কোরআনে অধিক বিজ্ঞ কে? যখন তাদের কোন একজনের প্রতি ইশারা করা হল, তখন তিনি তাকেই আগে কবরে নামানোর নির্দেশ দিলেন’। উক্ত ঘটনায় কোরআনে পারদর্শিতা অর্জনের সম্মান বর্ণিত হয়েছে। যা জীবিত ও মৃত সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য।
প্রকৃত কোরআন ধারীরাই আল্লাহওয়ালা: কোরআন তেলাওয়াত করা এবং তার আয়াতগুলি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা ও সেগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহওয়ালা হওয়া যায়। রাসূল (সা.) বলেন, দুনিয়াতে মানুষের মধ্যে কতিপয় আল্লাহওয়ালা রয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! তারা আবার কারা? তিনি বলেন,أَهْلُ الْقُرْآنِ هُمْ أَهْلُ اللهِ وَخَاصَّتُهُ- ‘কোরআন ওয়ালারাই প্রকৃত আল্লাহওয়ালা এবং তার নিকটতর। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালোবেসে কোরআন মাজীদ তেলাওয়াত করবে, স্বয়ং আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন এবং তাকে তার নিকটবর্তী হিসাবে গণ্য করেন।
বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শিক্ষার গুরুত্ব: বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা জরুরি। কুরআন তেলাওয়াতের সময় মাখরাজ সমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ না করলে বা তাজবীদের নিয়ম সমূহ পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ না করলে অনেক সময় আয়াতের মর্ম পরিবর্তন হয়ে যায়। যাতে পাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব ধীরে-সুস্থে ও বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা জরুরি।
কোরআনওয়ালাদের সঙ্গে ঈর্ষা: মহাগ্রন্থ কোরআন মাজীদের বক্তব্য প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সুগভীর। একে যথাযথভাবে আয়ত্ত্বকারীগণ মহাপুরুষ। ভালো কাজের আগ্রহ থেকে তাদের প্রতি ঈর্ষা করায় কোন দোষ নেই। তবে কারো প্রতি অন্যায়ভাবে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
কোরআনের পরিপূর্ণ হেফাজত জরুরি: পবিত্র কোরআনের যথার্থ হেফাজত করতে হবে। মুখস্থকৃত সূরা বা আয়াত বারবার তেলাওয়াতের মাধ্যমে কোরআন বিস্মৃতি থেকে দূরে থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,تَعَاهَدُوا هَذَا الْقُرْآنَ، فَوَالَّذِىْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَهُوَ أَشَدُّ تَفَلُّتًا مِّنَ الإِبِلِ فِى عُقُلِهَا- ‘তোমরা কোরআনের যথাযথ হেফাজত ও সংরক্ষণ কর। সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন, অবশ্যই উট তার রশি থেকে যেমন দ্রুত পালিয়ে যায় তার চেয়েও দ্রুত বেগে এ কোরআন চলে যায়’। অর্থাৎ কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি যত্নবান না হলে কুরআন স্মৃতি থেকে দ্রুত হারিয়ে যাবে।
রমজানে অধিকহারে কোরআন তেলাওয়াত: রমজান মাসে হেরাগুহায় কোরআন নাজিলের সূচনা হয়। ইবনু আববাস (রা.) বলেন, প্রতি বছর (রমজানে) জিবরাইল (আ.) রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে একবার কোরআন পাঠের পুনরাবৃত্তি করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন সে বছর তিনি রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে দু’বার কোরআন পাঠ করেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘জিবরাইল (আ.) রামাজান শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি রাতেই রাসূল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তখন নবী করীম (সা.) তাকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন’। অতএব রামজান মাসে অন্তত একবার পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করে শেষ করা উত্তম।