পাহাড়ের অবৈধ বাসিন্দারা কীভাবে সেবা সংযোগ পান!
২০০৭ সালের ১১ জুন নগরে পাহাড় ধসে প্রাণ হারায় ১২৭ জন। এ ঘটনায় সরকারিভাবে ঘটিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গঠন করা হয় ‘চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। প্রতিবছর বর্ষা এলে সভা করে এ কমিটি। অধিকাংশ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করা হবে এবং পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বাসা–বাড়িতে দেয়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কিছুদিন অভিযানও চলে। কয়েকদিন না পেরুতেই আবারও পাহাড়ে ফিরে যায় অবৈধ দখলকারীরা। রহস্যজনকভাবে সেবা সংস্থার সংযোগও ফিরে আসে। শুরু হয়েছে বর্ষাকাল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক সতর্কবার্তায় গত বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘন্টায় (আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত) ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনার কথা জানায়। একইসঙ্গে ভারী বর্ষণে ভূমিধসের সতর্কবার্তা জারি করে। এ ঘোষণার পরদিন বৃহস্পতিবার বিকেলে সভা (২৮তম) করে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি। যথারীতি এ সভায়ও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের ১৫ দিনের মধ্যে উচ্ছেদ এবং সেবা সংস্থার সংযোগ (গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি) বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সভায় জানানো হয়, চট্টগ্রামের ২৬টি পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা বর্তমানে ৬ হাজার ৫৫৮টি। ২৬ পাহাড়ের ১৬টি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের এবং বাকি দশটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ।
পদাধিকার বলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির আহ্বায়ক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কমিটির সদস্য সচিব। সভায় বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের অবৈধ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম ওয়াসা, পিডিবি (বিদ্যুৎ) ও কেজিডিসিএল (গ্যাস) প্রতিনিধিদের কাছে অবৈধ সংযোগের বিষয়ে জানতে চান এবং পাহাড়ের অবৈধ সেবা সংযোগ দ্রুত বিচ্ছিন্ন করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
মো. তোফায়েল ইসলাম বলেন, একটু ভারী বৃষ্টি হলেই পাহাড় ধসের শঙ্কা দেখা দিচ্ছে। পাহাড়গুলোতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। অবৈধ এসব বিদ্যুৎ সংযোগ আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। পানি ও গ্যাসের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা থাকবে। ১৫ দিন পর এ সংক্রান্ত বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে তথ্য দিতে হবে।
সভায় উপস্থিত সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, পাহাড়ের অবৈধ বাসিন্দারা কীভাবে সেবা সংযোগ পান? এসব বিষয়ে আপানাদের বার বার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এখন আবার উচ্ছেদ চালিয়ে প্রতিবেদন দেবেন।
তিনি বলেন, ‘যারা পাহাড়ে অবৈধভাবে আছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আমরা যতটুকু পেরেছি করেছি। যদি কেউ যেতে চায় তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে। কয়েকদিন আগেও চট্টগ্রাম বিভাগে সাড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনায় এনজিওগুলো পিচঢালা রাস্তা করে দিচ্ছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, কোন কোন এনজিও এ কাজ করছে, নামগুলো দেন। কারা করেছে? পাহাড়ে অবৈধ স্থাপনায় বৈধ রাস্তা, এটা কীভাবে সম্ভব! রাস্তার কাজ তো সিডিএ ও সিটি করপোরেশন করে। এ সময় তিনি চট্টগ্রাম, সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএ প্রতিনিধির কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তারা বিষয়টি জানেন না বলে জানান। এরপর তিনি পাহাড়ে রাস্তা করার পেছনে যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবৈধভাবে বসবাসকারীদের পাহাড় থেকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ এবং তাদের পুনর্বাসন দীর্ঘমেয়াদী বিষয়। সমস্যা হল, তারা পাহাড় ছেড়ে যেতে চান না। এর পরও আশ্রায়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের অনেককেই যে পুনর্বাসন করা হয়নি, তা নয়।
সভা শেষে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, গত এক বছরে প্রায় ১০ একর খাসজমি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ৩৬টি পাহাড় উদ্ধার করে সেখানে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, যেন সেখানে কেউ পাহাড় না কাটে। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় দেখা যায় পাহাড় কাটা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কিছু পাহাড়ের মালিকানায় সরকারি বিভিন্ন দপ্তর আছে। সেখানে আমরা অভিযান চালাতে পারিনি। সেখানে পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো হচ্ছে। বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক বলেন, বৃষ্টির পূর্বাভাসের পর নতুন করে পাহাড় থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত এক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে বিভিন্ন পাহাড়ে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক বলেন, তালিকা করে আমাদের দিলে আমরা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে সেখানে অভিযান চালাব। গত এক বছরে আমরা ৫১টি উচ্ছেদ অভিযান করেছি। কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দুজন কাউন্সিলরও পাহাড় কাটার দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বরখাস্ত করতে সুপারিশ করা হয়েছিল। সে সুপারিশের ভিত্তিতে তাদের বরখাস্তও করা হয়। পরে তারা হাইকোর্টে গিয়ে একটি আদেশ নিয়ে এসে আবার কাজ করছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, ছয় হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে। এ রকম বিুুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে সরিয়ে আনা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়।
সভায় অন্যন্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম, চসিকের সহকারী প্রকৌশলী মাহমুদ শাফকাত আমিন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক, পরিবেশ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস, ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী সজীব বড়ুয়া, র্যাব–৭–এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর সানরিয়া চৌধুরী।