আন্তর্জাতিক

পুতিন-কিম বন্ধুত্বে চীনের ভূমিকা কি?

দীর্ঘ ২৪ বছর পর ২ দিনের সফরে উত্তর কোরিয়া গিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে পুতিন এবং কিম জং আন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন যেখানে তাদের দুই দেশের বিরুদ্ধে যে কোন ‘আগ্রাসনে’ তারা পরস্পরকে সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন।

পিয়ংইয়ং সফরে এসে মি. কিমের সাথে বৈঠকের পর এ ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। কিম বলেছেন এটি তাদের সম্পর্ককে ‘একটি নতুন, সহযোগিতার অনন্য মাত্রা’ দিয়েছে।

তবে চুক্তিটি তাদের দ্রুত ঘনিষ্ঠ হওয়া সম্পর্ককে আর জমাট বাধাবে বলে পশ্চিমাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।

তবে বিমানবন্দরের টারমাকে রাত তিনটায় স্বাগত জানানো, সৈনিকদের অনার গার্ড, পিয়ংইয়ং এর সড়ক জুড়ে ভ্লাদিমির পুতিন এবং কিম জং আনের বিশাল সব পোট্রেট পাশাপাশি রাখা—এর সবই করা হয়েছে পশ্চিমাদের চিন্তায় ফেলার জন্য।

কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো দুই নেতাই অনুভব করেছেন যে তাদের পরস্পরকে প্রয়োজন – মি. পুতিনের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য গোলাবারুদ দরকার আর নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা উত্তর কোরিয়ার দরকার অর্থ।

যদিও ওই অঞ্চলের প্রকৃত শক্তি পিয়ংইয়ং নয়—এবং তারা তা হতেও চায়নি।

রাশিয়া আর উত্তর কোরিয়া – দুই দেশের এই নতুন করে যে বন্ধনের সূত্রপাত তা কৌশলগত কারণেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুতিন ‘প্রগাঢ় বন্ধুত্বের’ জন্য কিমের প্রশংসা করলেও তিনি জানেন তারও একটি সীমা আছে। আর সেই সীমাটি হলো চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

সতর্ক বেইজিং : এরই মধ্যে কিছু কার্যকলাপে বোঝা যাচ্ছে যে, চীনা প্রেসিডেন্ট তার দুই সহযোগী দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সখ্যতায় খুব একটা সন্তুষ্ট নন।

খবর বেরিয়েছিলো যে বেইজিং পুতিনকে গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট শি’র সাথে বৈঠকের পর পিয়ংইয়ং সফরে না যেতে সরাসরিই বলেছিলো। মনে হচ্ছে চীনা কর্মকর্তারা সেই সফরে উত্তর কোরিয়াকে টেনে আনাটা পছন্দ করেননি।

এছাড়া প্রেসিডেন্ট শি মস্কোকে সমর্থন দেয়ার বিষয়ে এবং ইউক্রেন যু্দ্ধে সহায়তা হয় এমন কিছু বিক্রি না করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাপের মধ্যে আছেন এবং তিনি এসব সতর্কতা পুরোপুরি উপেক্ষাও করতে পারেন না। কারণ বেইজিংয়ের বিদেশী পর্যটক এবং বিনিয়োগ দরকার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য।

এছাড়া চীনের এই নেতা বৈশ্বিক পর্যায়ে আরও বড় ভূমিকা রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে চান। তাই বুঝাই যাচ্ছে তিনি নতুন করে পশ্চিমা চাপ আর চাইবেন না। একই সাথে তিনি মস্কোর সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখবেন।

উত্তেজনা বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ দেখা যায় প্রশান্ত মহাসাগরে যা ‘ইস্ট এশিয়ান নেটো’ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট শি’র ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। বেইজিংয়ে অননুমোদন হয়তো উত্তর কোরিয়ায় রাশিয়ান সামরিক প্রযুক্তির বিক্রি বাড়িয়ে দিতে পারে। সেটাও যুক্তরাষ্ট্রের বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন মনে হয় না রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে বিশাল পরিমাণে কোন সামরিক প্রযুক্তি দেবে। সেটি করলে রাশিয়ার জন্য ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

পিয়ংইয়ং এর চীনকে দরকার আরও বেশি। এটি একমাত্র দেশ যেখানে কিম সফর করেছেন। উত্তর কোরিয়ার এক চতুর্থাংশ থেকে অর্ধেক পর্যন্ত তেল আসে রাশিয়া থেকে কিন্তু ৮০ ভাগ ব্যবসাই চীনের সাথে।

সুতরাং পুতিন এবং কিম নিজেদের সহযোগী হিসেবে দেখালেও চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

চীনকে হারানোর গুরুত্ব বেশি : রাজনীতি বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা সত্ত্বেও, এটা একটি যুদ্ধকালীন অংশীদারিত্ব। এটি আরও অগ্রসর হতে পারে, কিন্তু এখন সেটা অনেকটাই লেনদেন ভিত্তিক, এমনকি তাদের অংশীদারিত্বের মাত্রা বাড়লেও।

দুই দেশের মধ্যে সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি সত্ত্বেও পিয়ংইয়ং গোলাবারুদ সরবরাহ অব্যাহত রাখবে এমন নিশ্চয়তা নেই। বিশ্লেষকরাও মনে করেন রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া ভিন্ন ধরণের অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করে। উত্তর কোরিয়ার মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।

আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো দেশ দুটি কয়েক দশক ধরে তাদের সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেয়নি।

যখন পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিলো তখন মি. পুতিন দুবার পিয়ংইয়ংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন এবং উত্তর কোরিয়া যাতে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন।

যখন কিম ২০১৮ সালের কূটনৈতিকভাবে প্রবল চাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন তখন তিনি একবার ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন।

অন্যদিকে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি ছিলেন তার জন্য প্রথম কোন আন্তর্জাতিক নেতা, যার সাথে তিনি বৈঠক করেছিলেন। তারা তিনবার বৈঠক করেছেন। সুতরাং বন্ধু তালিকায় পুতিন নতুন।

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদপত্রে রাশিয়ার নেতা যে কলাম লিখেছেন সেখানে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বার্থের কথা বলেছেন। তবে, সেখানে চীনা প্রেসিডেন্টের বিষয়টি আসেনি, যাকে তিনি ‘ঘনিষ্ঠ ভাই’ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন। এমনকি তার পরিবার চীনা ভাষা শিখছে বলেও বলেছিলেন।

বিবিসি বলছে, তারা দুজনই চীনের সাহায্যপ্রার্থী এবং চীনকে ছাড়া তাদের শাসন সংকটে পড়বে। ফলে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষি বিষয়ে চীনের ভূমিকা থাকবেই। সূত্র: বিবিসি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *