রাজনীতি

প্রতীকসহ নিবন্ধন ফেরত পাওয়ার আশা জামায়াতে ইসলামীর

প্রতীকসহ নিবন্ধন ফেরত পাবে বলে আশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তবে এ জন্য জামায়াতে ইসলামী আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার কথা বলছে।

ধারাবাহিকতাগুলো হচ্ছে, প্রথমে নিবন্ধনের জন্য আপিলের পুনরুজ্জীবন। আর সেটার অনুমতি পাওয়া গেলে আপিলের পূর্ণাঙ্গ শুনানি হবে।

২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ রিট করেন। রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। আবেদনকারীরা জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আরজি জানান।

এ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুইবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুইবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।

২০১৩ সালের ১২ জুন ওই রুলের শুনানি শেষ হয়। একই বছরের ১ আগস্ট জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ বলে রায় দেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ।

সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয়া আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে আদালত জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করারও অনুমোদন দিয়ে দেন। তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন তৎকালীন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে একই বছরের ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।

এর মধ্যে ২০১৬ সালে ন্যায়ের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে যেন বরাদ্দ না দেওয়া হয় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন সুপ্রিম কোর্ট।

ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের এ সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। তার আগে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট (সব বিচারপতির অংশগ্রহণের সভা) সভায় দাঁড়িপাল্লার বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত হয়।

পরে ২০১৭ সালের মার্চে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বাদ দেয় নির্বাচন কমিশন।

এ অবস্থায় গত বছরের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এদিন আদালতে রিটকারীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানীয়া আমীর ও আহসানুল করীম। জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. জিয়াউর রহমান।

ওইদিন আইনজীবী জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের সিনিয়র আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধা ছিল। আর অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীনও অনুপস্থিত ছিলেন। এ ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে ছয় সপ্তাহ সময় চেয়েছিলাম। যেহেতু আমাদের আইনজীবীরা উপস্থিত নেই সেহেতু আদালত এটা ডিসমিস ফর ডিফল্ট করেছেন। অর্থাৎ আইনজীবী উপস্থিত না থাকার কারণে খারিজ করেছেন।

পরে আইনি সুযোগ কী আছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, রেস্টোর (পুনরায় শুনানির জন্য) আবেদনের সুযোগ আছে। সেক্ষেত্রে এটা আদালতের এখতিয়ার।

এরপর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ফের আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। গত জুলাই মাসে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে কোটা প্রথা সংস্কারে রাজপথে আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলে। এর মধ্যে ১ আগস্ট সরকার অঙ্গসংগঠনসহ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পরে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের আবেদন বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ২৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার আগের নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল করে।

নিষিদ্ধের আদেশ বাতিলের পর ১ সেপ্টেম্বর রোববার নিবন্ধন নিয়ে আপিল রেস্টোরেশন (পুনরুজ্জীবন) চেয়ে আবেদন করে জামায়াতে ইসলামী। এদিন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম রেস্টোরেশনের ওপর শুনানির জন্য ২১ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন।

জামায়াতে ইসলামীর প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, রেস্টোরেশন যদি অ্যালাউ হয়, এরপর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, জামায়াতে ইসলামী একটি বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে তার নিবন্ধন ফিরে পাবে এবং বৈধভাবে বাংলাদেশে রাজনীতি করবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা রেস্টোরেশন ফার্স্ট। আইনের ধারাবাহিকতায় আমাদের যেতে হবে। আমরা আশা করছি, রেস্টোরেশন অ্যালাউ হবে। এরপরে শুনানি হবে।

মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, একটা রাজনৈতিক দল নিবন্ধনপ্রাপ্ত হয় প্রতীকসহ। প্রতীকসহ জামায়াতে ইসলামী তার নিবন্ধন ফিরে পাবে বলে আমরা আশা করি।

জামায়াতের নিযুক্ত আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, হাইকোর্ট ডিভিশন জামায়াতের নিবন্ধনের ব্যাপারে ডিভাইডেড। দুই জন বিচারপতি নিবন্ধন বাতিল করে রায় দিয়েছেন। আরেকজন বিচারপতি নিবন্ধনের পক্ষে রায় দিয়েছেন। নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে যিনি মূল যুক্তি দিয়েছেন তিনিই বলেছেন, যে ব্যক্তি নিবন্ধনের মামলা এইভাবে বাতিল করার জন্য (রিট) দায়ের করেছেন তিনি নিজেই পক্ষ দোষে দুষ্ট। ধর্মীয় আচার আচরণের ভিত্তিতে পৃথিবীর কোথাও নিষিদ্ধ করা হয় না। জামায়াত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পার্টি। সব সংসদে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এভাবে কোনো দলের নিবন্ধন বাতিল করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এটা গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ, সংবিধানের পরিপন্থী। এ জন্য এটি কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ডেমোক্রেসিতে কোনো পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয় না। পিপলকে বলা হয়, কে ভালো কে খারাপ জনগণই নির্ধারণ করবে। আদালত বা বিশেষ ক্ষমতাসীন লোক এটা নির্ধারণ করে না। এটা ডেমোক্রেসির নিয়ম নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *