বিআরটিএর হালচাল: একদিকে ভোগান্তি, অন্য দিকে দালাল
‘স্যার, লাইসেন্স করাইবেন নাকি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করাইবেন? আপনার কষ্ট কইরা করা লাগবো না; আমরা কইরা দিমু। আপনে খালি কতক্ষণ অপেক্ষা করবেন।
সরকারি যা খরচ হইবো তার চাইয়া ৫ হাজার ট্যাকা বেশি দিবেন স্যার। ’
কথাগুলো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে অবস্থানরত দালালদের। এসব সরকারি কার্যালয়ে যারা গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বা ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে আসেন, প্রতিনিয়ত শুনে থাকেন।
কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় বিআরটিএর একটি কার্যালয় রয়েছে। সেখানে রয়েছে দালালের আধিক্য। যারাই ইকুরিয়া বিআরটিএ যান, তাদের পেছনেই লেগে যায় দালাল চক্রের সদস্যরা। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা নিজের কর্ম সারেন, লেনদেন করেন।
এসব দালালের হাত রয়েছে বিআরটিএর নতুন লাইসেন্স তৈরি- নবায়ন, নতুন-পুরনো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, মালিকানা পরিবর্তন, গাড়ি ও ড্রাইভিং স্কিল টেস্ট বিভাগেও।
শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকারের আমলে সেবা গ্রহীতারা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তেন। দেশের সব বিআরটিএ কার্যালয়েই একই পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। তা ছাড়া দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে ভোগান্তি বাড়ত আরও বহুগুণে।
সম্প্রতি কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় একদল দুর্বৃত্ত বিআরটিএর সার্ভারে আগুন দেয়। পুড়ে যাওয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিআরটিএর অন্যান্য কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। এ সুযোগ নিয়েছে বিভিন্ন স্তরের দালালেরা।
একদিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে, নবায়ন করতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। বারবার সময় দিয়েও কথা রাখতে পারছে না বিআরটিএ। এ ছাড়া গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, নতুন-পুরনো গাড়ির মালিকানা বদলির বুথেও দীর্ঘ লাইন হচ্ছে। মাথার ওপর রোদ-বৃষ্টি নিয়ে এসব বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন সেবা গ্রহীতারা। তার ওপর আবার দালালদের উৎপাত।
যান পরিদর্শক সালেহ উদ্দিন বলেন, কয়েকদিন সার্ভার বন্ধ থাকায় কাজের চাপ বেশি। তবে ধীরে ধীরে ভোগান্তি কমছে।
সরেজমিনে ইকুরিয়ায় বিআরটিএর কার্যালয়ের দেখা যায়, মূল ভবন অন্ধকারাচ্ছন্ন। দিনের আলো থাকার পরও অফিসের এ পরিস্থিতি কোনো কর্মকর্তা না আসার কারণে। তাদের কক্ষ-চেয়ার ফাঁকা ও দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় এ পরিস্থিতি হয়েছে। যারা আছেন, নিজেরা নিজেদের মতো সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু বাইরে বা বুথে গ্রাহকদের ভিড় লেগেই আছে।
মানিকনগর থেকে আসা সোহেল জানান, তিনি বেলা ১১টার দিকে লাইনে দাঁড়িয়েছেন নতুন মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন করবেন বলে। দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় তিনি বিপাকে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা না থাকায় তিনি কাজও করাতে পারছেন না।
হঠাৎ মূল ভবনের বাইরে হট্টগোল বাধে। দেখা যায়, সেবাগ্রহীতাদের অর্থ নেওয়া, হয়রানি ও হেনস্তা করার অভিযোগে কার্যালয়ের ব্যাংকসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাঁচ দালালকে ধরেছে সাদা পোষাকে থাকা আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। দালালদের মারধরের চেষ্টা করছেন কয়েকজন। পরে আইন রক্ষায় নিয়োজিত এক সদস্য দালালদের একটি রুমে নিয়ে আটকে রাখেন। জানান, ম্যাজিস্ট্রেটকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেবা গ্রহীতারা জানান, ইকুরিয়া বিআরটিএর মূল সমস্যা ছিল দালাল। এদের নিয়ন্ত্রণ করতো কেরানীগঞ্জ ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতারা। নেতারা পালিয়েছে, কিন্তু তাদের দোসররা রয়ে গেছে। আগের দৃশ্যমান ছিল। এখন নেই। কিন্তু গোপনে কাজ করতে আসে। অনেক সময় ধরা খায়।
দালাল থাকলে কাজ তাড়াতাড়ি হয় বলেও স্বীকার করেছেন সেবা গ্রহীতারা। তাদের ভাষ্য, কাজ দ্রুত হলেও এটা কোনো নৈতিক বিষয় নয়। বিআরটিএ কর্মকর্তাদের গতিশীল হতে হবে।
আটক দালাল চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কথা হলে তারা নিজেদের প্রথমে নির্দোষ দাবি করে। পরে অবশ্য নিজেদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানিয়েছে তারা। দলগত ভাবে কাজ করলেও তারা মানুষের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় জড়ান না। যা আয় হয়, দিন শেষে ভাগাভাগি করে নেয় তারা।
কেরানীগঞ্জ ইকুরিয়া বিআরটিএর ডেপুটি ডিরেক্টর প্রকৌশলী সানাউল হক এ ব্যাপারে বলেন, আমরা সবসময় চেষ্টা করছি বিআরটিএকে দালালমুক্ত করতে। দালাল ধরা মাত্রই আমরা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে তুলে দিই। শাস্তির আওতায় আনি। তারপরও দ্রুত সময়ে কাজ করিয়ে নিতে কেউ দালালদের খপ্পরে পড়ে গেলে সেই দায়ভার তো আমাদের না। আমাদের প্রতিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে, কোনো রকম দুর্নীতি করা যাবে না।
বিদ্যুৎ না থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই এলাকায় লোডশেডিং হয় না প্রায় কয়েক বছর। এই সময় আমাদের কয়েকটা জেনারেটর ব্যবহারই করা হতো না। তাই হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া জেনারেটর চালু করতে গিয়ে দেখা যায় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। দ্রুতই সমাধানের চেষ্টা চলছে।
ড্রাইভিং লাইসেন্সের ধীরগতিসহ আরও বেশ কয়েকটি বিষয়ে জানতে চাইলে সানাউল হক বলেন, আমাদের হেড অফিসের নির্দিষ্ট উইং আছে সেখান থেকে এসব তথ্য জানা যাবে। আমরা এসব বিষয়ে কথা বলতে পারব না।