‘বিষাক্ত’ তরল বেরুচ্ছে দেয়ালের ফুটো দিয়ে!
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ইছানগরে এস আলম সুগার মিলের আগুন এখনো জ্বলছে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ছিটাচ্ছেন পানি। সেই পানি পুড়ে যাওয়া অপরিশোধিত চিনির সঙ্গে মিশে ‘বিষাক্ত’ তরলে রূপ নিয়েছে। রঙ ধারণ করেছে কুচকুচে কালো। আর সেই তরলে ছেয়ে গেছে আশপাশের সড়ক। সড়ক বেয়ে নালা-নর্দমা হয়ে এসব তরল যাচ্ছে পাশের খাল-নদীতে। সড়ক পিচ্ছিল হয়ে পথচারীদের চলাচলে ঘটছে বিঘ্ন। খাল-নদীতে ভাসছে মরা মাছ।
অথচ আগুন লাগার পরদিন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এস আলম গ্রুপের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছিলেন, চিনিকলের বিষাক্ত তরলগুলো সরিয়ে তাদের নিজস্ব খালি জায়গায় নিয়ে গিয়ে ডাম্পিং করা হচ্ছে, যাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু সরেজমিন দেখা গেল কর্মকর্তাদের বক্তব্যের উল্টোচিত্র।
বুধবার (৬ মার্চ) দুপুরে দেখা গেছে, কারখানা থেকে ‘বিষাক্ত’ তরল সীমানাপ্রাচীরের (দেয়াল) ফুটো দিয়ে বেয়ে পড়ছে পাশের সড়কে। সড়ক হয়ে গেছে পিচ্ছিল। পথচারীর হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, কারাখানাকর্মীরাই সীমানাপ্রাচীরের নিচের অংশ ভেঙে ছিদ্র করে দিয়েছেন। যাতে ভেতরের পানিগুলো দ্রুত বেরিয়ে আসে।
মোহাম্মদ শাহাজাহান নামে একজন পথচারী বলেন, ‘আজ (বুধবার) সকালে কারখানার দেয়ালের নিচের অংশে একাধিক ছিদ্র করে দেয়া হয়। ওই ছিদ্র দিয়ে ভেতরে জমে থাকা বিষাক্ত তরলগুলো বাইরে চলে আসছে। ওরা ওদের স্বার্থ চিন্তা করেছে। জনগণ বা পথচারীর চিন্তা করার সময় কই ওদের! পাশের সড়কজুড়ে বিষাক্ত তরল এবং পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।’
তিনি জানান, কারখানা ঘেঁষে যে সড়কটি রয়েছে, তা দিয়ে অনেক মানুষ চলাফেরা করে। আগুন লাগার পর অর্থাৎ মঙ্গলবার পর্যন্ত ওই সড়কে হাঁটতে সমস্যা হয়নি। বুধবার কারখানার ভেতরের তরলগুলো সড়কে এসে পড়েছে। এতে পথচারীদের হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে।
তবে এস আলম গ্রুপের হেড অব স্টেট মোস্তান বিল্লাহ আদিল বলেন, ‘প্রায় ৩০টি ডাম্পট্রাক দিয়ে আগুনে গলে যাওয়া র-সুগার আমাদের নিজস্ব জায়গায় ডাম্পিং করা হচ্ছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি র-সুগার যাতে নদীতে না পড়ে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। এর পরও ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো কিছু পানি গড়িয়ে নদীতে পড়েছে। এতে আমাদের দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
ষড়যন্ত্র নাশকতা নাকি অন্যকিছু!
এদিকে আগুন নেভাতে প্রায় ৪৭ ঘণ্টা পালাবদল করে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এতে অনেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। পুড়ে গলে যাওয়া অপরিশোধিত চিনির গরম তরলের কারণে কাজ করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এগুলো না সরালে আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হবে না।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ হারুন পাশা বুধবার বিকেলে বলেন, ‘ভেতরে এখনো আগুন আছে। দাহ্য পদার্থ অনেক বেশি। এগুলো যতক্ষণ না সরানো যাবে ততক্ষণ আগুন জ্বলতে থাকবে।’
আগুন অন্য জায়গায় ছড়ানোর আশঙ্কা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, ছড়ানোর আশঙ্কা নেই। আমরা চেষ্টা করছি আগুনটা যাতে না ছড়ায়। অন্যান্য প্লান্টে (গোডাউন) যাতে না যায়।’
আগুন নেভাতে বর্তমানে কয়টি ইউনিট কাজ করছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘১০টি ইউনিট কাজ করছে। আমরা শিফটিং (পালাবদল) করে কাজ করছি। আমরা টায়ার্ড (ক্লান্ত) হয়ে গেছি। এছাড়া চিনির ক্যারামেলগুলোর কারণে আমাদের (ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের) একটু সমস্যা হচ্ছে। এগুলো পায়ে লাগলে (সেফটি বুট থাকার পরেও) মনে হয় গরম অনুভব হয়, মনে হচ্ছে যেন সিদ্ধ হচ্ছি।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘ল্যাব থেকে একটি টিম গিয়ে কারখানা থেকে বের হওয়া তরল ও নদীর পানির নমুনা সংগ্রহ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে পুড়ে যাওয়া চিনির কাঁচামাল এবং ফায়ার সার্ভিসের পানি একসাথে হয়ে সেগুলো নদীতে যাচ্ছে। এতে নদীতে একটু ইম্পেক্ট তৈরি হবে। নদী যেহেতু প্রবাহমান এবং জোয়ার-ভাটার নদী; এটা যখন (পানি) ডেসপার্চ হয়ে যাবে তখন আস্তে আস্তে প্রভাবটা কমে যাবে।’
মাছ মরে যাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় একটু অক্সিজেন সমস্যা হচ্ছে। তাই একাধিক লাইফে (মাছ) একটু ইম্পেক্ট হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পানি যেটা ভেতরে জমে আছে; সেটা অপসারণ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ হয়তো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে লক করেছিল। এখন পানিগুলো বের হওয়ার জন্য হয়তো দেয়ালে ছিদ্র করেছে। আমাদের একটি টিম গিয়েছিল ঘটনাস্থলে। কাল আরেকটি টিম যাবে পুরো বিষয়টি দেখার জন্য। আমরা অবশ্যই তাদের অবহিত করেছি বিষয়গুলো যাতে প্রপার মেনেজমেন্ট করার জন্য। তারাও জানিয়েছে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো প্রপারভাবে করছে। কারখানার বর্জ্যগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
বিষাক্ত পানিগুলো জনজীবনে কোনো সমস্যা করবে কিনা?- প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘র-সুগার এবং পানি মিলে কালো আকার ধারণ করেছে। তবে পানিগুলো অবশ্যই দূষিত পানি। তাই আমাদের পরামর্শ থাকবে, জনসাধারণ যাতে হাত-পায়ে না লাগাই। তবে এটা তো মেডিকেল ইস্যু। ধারণা থেকে বলছি। কিন্তু এই তরল বা পানি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করবে এমন কোনো পদার্থ সেখানে আছে কিনা সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছে। সেটার প্রতিবেদন পেলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
প্রসঙ্গত, সোমবার (৪ মার্চ) বিকেল ৩টা ৫৩ মিনিটে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের এই চিনিকলের একটি গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিকেল ৪টার দিকে খবর পেয়ে শুরুতে দুটি ইউনিট, পরে আরও ৫টি ইউনিটসহ মোট ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবু আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় যুক্ত হয় আরো ৭টি ইউনিট। সব মিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৪ ইউনিট কাজ করে। রাত ১১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয়নি। এখনো জ্বলছে আগুন।
এর আগে, গত শুক্রবার বাকলিয়া এক্সেস রোডে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন হিমাগারে আগুন লাগে। তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও বিকেল পেরিয়ে যায় পুরোপুরি নেভাতে। তবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সম্পর্কে এখনো জানা যায়নি।