ভাসমান দোকানে ভালো মানের জুতা!
চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থানার বিজয়নগর এলাকার বাসিন্দা মো. সাদেক। পেশায় পোশাকশ্রমিক এই যুবকের বাড়ি ময়মনসিংহ। জীবিকার তাগিদে স্ত্রী-সন্তানসহ থাকেন এখানে। আগ্রাবাদের অভিজাত শপিংমল আখতারুজ্জামান সেন্টার ফেলেই তিনি হাঁটছিলেন ডানপাশের ফুটপাত ধরে। কিছুক্ষণ পরই ফুটপাতের পাশে থাকা ভাসমান জুতার বাজারের একটি স্টলের সামনে থামেন তিনি। এরপরই পছন্দসই জুতা খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সেখানে দরদামে বনিবনা না হওয়ায় ফের আরেক স্টলে তিনি ঢুঁ মারবেন—সেই ফাঁকেই তাঁর সঙ্গে কথা। জানালেন, কম দামে ভালো মানের জুতার জন্যই তিনি এখানে এসেছেন। বলেন, ‘কম দামে ভালো মানের জুতা পাওয়ায় অনেক বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজনরাও এখান থেকেই জুতা কেনেন। তাই, প্রতিবারের মতো এবারের ঈদেও নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানের জুতা কিনতে এই ভাসমান বাজারকেই বেছে নিয়েছি।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, আগ্রাবাদ অফিসপাড়া এলাকায় বিকেলে থেকে ফুটপাত ঘেঁষেই তিন শতাধিক ভাসমান দোকান বসে। সেখানে সাজিয়ে রাখা রঙ-বেরঙয়ের জুতা নজর কাড়ছে ক্রেতাদের। ক্রেতারাও যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন নিজের এবং পরিবারের সদস্যের জন্য পছন্দের জুতা কিনতে।
পোশাক শ্রমিক সাদেক সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘আমি এখন যে জুতা পড়ে আছি এটিও এখান থেকে ১৫শ টাকায় কেনা প্রায় একবছর আগে। এখনো বেশ ভালোভাবেই পড়ছি। এবারের ঈদে গ্রামে যাবো। তাই মেয়ে, স্ত্রী, নিজের জন্য জুতা কিনতে আসা। আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের জন্য দামে কম মানে ভালো জুতা এখানে ছাড়া আর কই পাবো?’
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র মোহাম্মদ রাফি বলেন, ‘আমার বাবা-মা থাকেন বাড়িতে। আমি এখানে ব্যাচেলর থাকি। জুতা কিনতে টাকা এনেছি বাড়ি থেকে। এখানে এসেছি কিছুটা সাশ্রয়ে কিনতে। বেঁচে যাওয়া টাকা আবার অন্য কাজে লাগাতে পারবো।’
আগ্রাবাদেরই বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মো. রিয়াজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এই এলাকায় চাকরি করি প্রায় চার বছর। এই অফিসে জয়েন করার পর থেকে এখান থেকেই জুতা কিনি। দু-একবার ছাড়া আর কোনোবারই ঠকিনি। এখন কিছু বিক্রেতার সাথেও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। তাই ভালো মানের জুতাই দেন।’
জুতা কেনায় আছে ‘ঝুঁকিও’
নগরের একমাত্র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের অবস্থান আগ্রাবাদে। আছে ব্যাংক-বীমাসহ সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার প্রধান কার্যালয়। এখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় আমদানি-রপ্তানিসহ কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। এই এলাকাকে ‘ব্যাংকপাড়া’ হিসেবেও চেনেন অনেকে।
তবে ‘ব্যাংকপাড়া’ খ্যাত আগ্রাবাদের ফুটপাতের এই ভাসমান জুতার বাজারের জুতা নিয়ে সাদেকের মুখে যতটা প্রশংসা, ঠিক ততটাই ঝুঁকির শঙ্কা শোনা গেল আরেক ক্রেতা ইসমাইল শুভ’র মুখে।
তিনি বলেন, ‘কম দামে আর কতো ভালো জিনিস এরা দেবে? এখানে দেখবেন এপেক্স বা বাটার লোগো লাগানো অনেক ধরনের জুতা আছে। কিন্তু এগুলা সবই আসলে নকল ব্র্যান্ড। কাকের গায়ে ময়ুরের পেখম লাগানোর মতো। সাময়িক ব্যবহারের জন্য এখানকার জুতা ঠিক আছে। তবে সবসময় নয়।’
ব্যবসায়ীদের দাবি, গুণগত মান কম নয়, বরং ভালো মানের জুতাই তারা বিক্রি করেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নকল পণ্য বিক্রি করলেও ক্রেতারা যাচাই বাছাই করে কিনলে ঠকবেন না।
এই ‘ঝুঁকির’ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘মূলত আগ্রাবাদ থেকে অদূরেই রয়েছে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) এবং কর্ণফুলী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড)। এই দুই ইপিজেডে বিদেশি ক্রেতারা ক্রয়াদেশ দিলে কিছু জুতা শিপমেন্ট হয় না রিজেক্টের (ত্রুটি) কারণে। সেই রিজেক্ট প্রোডাক্টগুলো (জুতা) যখন বিদেশি ক্রেতারা নেয় না তখন সংশ্লিষ্ট কারখানা থেকে এগুলো বাইরে অনেক কম দামে বিক্রি করে। সেখান থেকেই জুতাগুলো সংগ্রহ করি আমরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখান থেকে কিনলে যে ক্রেতারা ঠকবেন বিষয়টি এমন নয়। হ্যাঁ, এগুলো রিজেক্টেড প্রোডাক্ট এটা ঠিক। তবে আহামরি রিজেক্ট নয়। বিদেশি ক্রেতারা ছোটখাটো খুঁত পেলেও নেয় না। আর সেগুলোই ছাড়া হয় আমাদের কাছে। আর কিছু নকল যে নেই তা নয়। অসাধু বলতে তো একটা শব্দ আছে। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতাদের সাবধানতা জরুরি।’
বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জুতা কি আসল?
কয়েকটি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, এপেক্স ফুটওয়্যার, বাটা, লোটো, জেনিস, ওয়াকারসহ নামীদামী ব্র্যান্ডেড জুতাও বিক্রি হচ্ছে সেখানে। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো আসল নাকি নকল। তবে হাতে ধরে দেখলে কিছুটা পার্থক্য চোখে পড়ে। আবার নামিদামি ব্র্যান্ডের নামের উচ্চাণের সাথে মিল রেখেও ডাটা, এপোক্সসহ বিভিন্ন নামে জুতা রয়েছে এসব স্টলে।
এসব জুতার মধ্যে যেসব ডিজাইন শো-রুমে বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় সেগুলো এখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকায়।
জানতে চাইলে মো. শফিক নামে এক ব্যবসায়ী অবশ্য স্বীকার করেছেন এমন প্রতারণার কথা। তিনি বলেন, ‘ভাই, তিন-চারশ টাকায় এপেক্স বা বাটার জুতা আপনি কেমনে পাবেন? স্থানীয় কারখানায় বানিয়ে জুতার ওপর নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো লাগিয়ে অনেক জুতাই বিক্রি করি।’
ক্রেতাদের সাথে এটি প্রতারণা করছেন কিনা—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতারণা আর কি? দাম কি বেশি রাখি? যেমন মান তেমন দাম।’
ব্যবসায়ী ছালেহ আহমদ বলেন, ‘এখানে যারা কেনে তারা নিম্নআয়ের মানুষ। অনেক ব্যাচেলর ছাত্র আর রিকশাওয়ালারাও আসে আমাদের কাছে। এখানে যদি দাম হাতের নাগালে না থাকে তাইলে তারা কিনবে কিভাবে? ঈদে বড়লোকরা হাজার হাজার টাকা দিয়ে বড় শপিংমল থেকে জুতা কেনে। কিন্তু গরিবরা হাজার টাকা কামাতে দুদিন শ্রম দিতে হয়৷ তারাই আমাদের কাছে আসে কিনতে।’