চট্টগ্রাম

মশা নিধনে পর্যাপ্ত লোকবল ও ওষুধ থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যর্থ চসিক?

চট্টগ্রামে মশার উপদ্রব এতটাই বেড়েছে যে বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। মশার উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন মশা নিধনের কার্যক্রম বাড়ায়নি, যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। এরই মধ্যে নগরীতে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে গেছে। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে ইতিমধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৭৩০ জন আক্রান্ত হয়েছেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ এবং এ থেকে বাঁচতে হলে মশার কামড় এড়াতে হবে।। সিটি করপোরেশনের উচিত মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করা।

চট্টগ্রাম নগরের ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের পূর্ব কাঠগড়ের বাসিন্দা শাহেদ হাসান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এবং চার দিন চিকিৎসা নিতে হয়েছে। তিনি জানান, বাড়ি ও কর্মস্থল, কোথাও মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি এবং সব জায়গাতেই মশার কামড় খেয়েছেন। তাই তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না যে কোথায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি নিজ এলাকায় ওষুধ ছিটানোর জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরকে বারবার অনুরোধ করেছেন, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। উল্টো তিনি নিজেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়েছে।

নগরীর টাইগারপাসে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী প্রধান কার্যালয় থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে লালখান বাজারে অবস্থিত সরকারি অফিসার্স কলোনির বাসিন্দা ফারজানা আক্তার ডেঙ্গুর মৌসুমে দুই শিশু সন্তান নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তায় আছেন। তিনি বলেন, মশার উৎপাতের কারণে বাচ্চাদের নিয়ে তিনি আতঙ্কে থাকেন। মশার কামড় থেকে বাঁচাতে তিনি বাচ্চাদের লোশন দেন এবং মশারিও টানান। তারপরও মশা কামড়াচ্ছে।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর চট্টগ্রামে ৭৩০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে চলতি মাসের (১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) ১১ দিনে ১৩২ জন, আগস্টে ২০২ জন, জুলাইয়ে ১৯৮ জন, জুনে ৪১ জন, মে মাসে ১৭ জন, এপ্রিলে ১৮ জন, মার্চে ২৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৫ জন এবং জানুয়ারিতে ৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

গত বছর, ২০২৩ সালে, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার ৮৭ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ১০৭ জনের। ২০২২ সালে ৫ হাজার ৪৪৫ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ৪১ জন মারা গিয়েছিলেন। ২০২১ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৭১ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫ জনের।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া জানিয়েছেন, চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে দুজন পুরুষ, ছয়জন নারী এবং একজন শিশু। এ বছর এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭৩০ জন, যার মধ্যে ২৯২ জন পুরুষ, ১৮৭ জন নারী এবং ১৫১ জন শিশু। এর মধ্যে ৪০৬ জন চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় এবং বাকি ৩২৪ জন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছেন।

জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দারা, সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩৩ জন। এরপরে আছে সাতকানিয়া (৪৪ জন), সীতাকুণ্ড (২৩ জন), বোয়ালখালী (২০ জন), হাটহাজারী (১৪ জন)। বাঁশখালী, পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়ায় ১৩ জন করে আক্রান্ত হয়েছেন। মীরসরাইয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন। অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

যদিও চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনও গত বছরের মতো তীব্র আকার ধারণ করেনি, তবে বিপদ এখনও কাটেনি। কারণ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কাল এডিস মশার প্রজননের প্রধান সময়। গত বছরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে চিকিৎসকরা এখনই মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ দিলেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

গত বছরের অভিজ্ঞতার কারণে নগরবাসীর মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে আশঙ্কা বিরাজ করছে, বিশেষ করে এখন মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়। কিন্তু নগরীতে মশার ওষুধ ছিটানোর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। নগরবাসীর অভিযোগ, পর্যাপ্ত জনবল ও ওষুধ মজুত থাকা সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন তা ব্যবহার করছে না।

পাঁচলাইশ থানার হামজারবাগ সংগীত আবাসিক এলাকার একজন বাসিন্দা জানান, তাঁর এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। গত এক বছরে তিনি কাউকে ওষুধ ছিটাতে আসতে দেখেননি। হয়তো সিটি করপোরেশনের কাগজে-কলমে মশা নিধন কার্যক্রম চলছে, কিন্তু বাস্তবে তা চোখে পড়ছে না। ওষুধ ছিটানো বন্ধ থাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে। বিকেলে কয়েল ছাড়া ঘরে বসা যায় না। মশার উৎপাত কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে।

বহদ্দারহাট এলাকার এক বাসিন্দাও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মশা নিধনে সিটি করপোরেশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং উদাসীন। প্রতি বছর মশা নিধনের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হলেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। নগরজুড়ে পর্যাপ্ত স্প্রে-ম্যান থাকলেও তারা ঠিকমতো ওষুধ ছিটাচ্ছে না।

চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি জানিয়েছেন যে এবার মশা নিধনে তাদের প্রস্তুতি ভালো। চসিকের গুদামে ছয় মাসের ওষুধ মজুত রয়েছে এবং জনবল ও ওষুধের কোনো ঘাটতি নেই। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে আগে যেখানে ২৫০ জন স্প্রেম্যান ছিল, বর্তমানে তা বাড়িয়ে ৩৫০ জন করা হয়েছে। বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর জন্য বিশেষ স্প্রে টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বর্তমানে মশাবাহিত রোগ কিছুটা বেড়েছে, তবে তিনি আশা করছেন নভেম্বরের মধ্যে মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসের (বিআইটিআইডি) অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও, হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তিনি বলেন, এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি কেমন হবে তা বায়ুর আর্দ্রতা সহ পরিবেশের উপর নির্ভর করবে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, এডিস মশার ডিম তিন বছর পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে এবং এই সময়ের মধ্যে যদি ডিম পানির সংস্পর্শে আসে তাহলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা পরিপূর্ণ মশায় পরিণত হয়। ডিম পাড়া মশার দেহে যদি ডেঙ্গুর ভাইরাস থাকে, তাহলে সেই ডিম থেকে যে মশা জন্মাবে তার মধ্যেও সেই ভাইরাস থাকবে এবং সেই মশা কাউকে কামড় দিলে সে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম জোর দিয়ে বলেছেন যে ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে মশা নিধন অপরিহার্য। তিনি জানান, সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে সিটি করপোরেশনকে আবারও চিঠি দেওয়া হয়েছে যাতে তারা মশা নিধন কার্যক্রম জোরদার করে। মশা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে ডেঙ্গু সহ সব ধরনের মশাবাহিত রোগ কমে আসবে।

তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার নতুন করে ১৬ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। জেলার প্রতিটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত ওষুধ মজুত রয়েছে। মাঠপর্যায়ের কর্মীদেরকে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *