ধর্ম

মহানবী সা.-কে যেভাবে শান্ত্বনা দিয়েছিলেন খাদিজা রা.

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়তের দায়িত্ব পেয়েছেন ৪০ বছর বয়সে। ৪০ বছর বয়সকে মানুষের বুদ্ধিমত্তার পরিপক্কতা ও পূর্ণতার সময়কাল বলা হয়ে থাকে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়ত লাভের আগে মানুষের কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। খাবার এবং পানি সঙ্গে নিয়ে মক্কা নগরী থেকে দু’মাইল দূরত্বে অবস্থিত হেরা পর্বতের গুহায় গিয়ে ধ্যানমগ্ন থাকতেন।

হেরা গুহা

হেরা পর্বতের যে গুহাটিতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধ্যানমগ্ন ও ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন তা আকার-আয়তনে একেবারে ছোট। এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে চার গজ এবং প্রস্থ পৌনে দু’গজ। এর নীচ দিকটা তেমন গভীর ছিল না। একটি ছোট্ট পথের প্রান্তভাগে অবস্থিত পর্বতের উপরি অংশের একত্রে মিলে মিশে ঠিক এমন একটি আকার আকৃতি ধারণ করেছিল যা শোভাযাত্রার পুরোভাগে অবস্থিত আরোহী শূন্য সুসজ্জিত অশ্বের মতো দেখায়। এতে কোনোমতে একজন মানুষ ইবাদত করতে পারেন।

নবুওয়ত লাভের আগমুর্হুতের সময়গুলোতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে একাকী, নিভৃতে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। হেরা গুহায় জিবরাঈল আলাইহিস সালাম নবুওয়ত নিয়ে আগমনের আগেই নবুওয়তের কিছু স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ হতে শুরু করে। সে লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। এই সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোনো স্বপ্ন দেখতেন তা প্রতীয়মান হতো সুবহে সাদেকের মতো।

হেরা গুহায় জিবরাঈল আ.-এর আগমন

এভাবে এক সময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহী বহনের পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করলেন। একদিন হেরা গুহায় ওহী নিয়ে আবির্ভাব ঘটলো জিবরাঈল আলাইহিস সালামের। জিবাঈল আলাইহিস সালাম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ اِقۡرَاۡ‘ইকরা’, আপনি পড়ুন’।

জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না’।

জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাকে আলিঙ্গন করে জোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, ‘আপনি পড়ুন’।
তিনি আবার জবাব দিলেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না’।

জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাকে আবার আলিঙ্গন করে জোরে চাপ দিলেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, ‘আপনি পড়ুন’। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই জবাব দিলেন আবারো, ‘আমি তো পড়তে জানি না’।

প্রথম ওহী

এবার জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাকে আলিঙ্গন করে জোরে চাপ দিয়ে বললেন,

اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّکَ الَّذِیۡ خَلَقَ ۚ ١ خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ عَلَقٍ ۚ ٢ اِقۡرَاۡ وَرَبُّکَ الۡاَکۡرَمُ ۙ ٣ الَّذِیۡ عَلَّمَ بِالۡقَلَمِ ۙ ٤ عَلَّمَ الۡاِنۡسَانَ مَا لَمۡ یَعۡلَمۡ ؕ ٥

পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি (সব কিছু) সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত দ্বারা। পড় এবং তোমার প্রতিপালক সর্বাপেক্ষা বেশি মহানুভব।যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না। (সূরা আলাক, (৯৬), আয়াত, ১-৫)

মহানবী সা. ঘরে ফিরলেন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তিনি সেখান থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় ঘরে ফিরলেন এবং খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কম্বলে ঢেকে দিলেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। তবে এমন অবস্থা দেখে নিজেও ঘাবড়ে গেলেন, কী হয়েছে বুঝতে পারলেন না। এরপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুটা শান্ত হয়ে পুরো ঘটনার বিবরণ শোনালেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহাকে এবং বললেন, ‘আমার ভয় হচ্ছে আমি মনে হয় আর বাঁচবো না’।

মহানবী সা.-কে যেভাবে শান্ত্বনা দিয়েছিলেন খাদিজা রা.

এর জবাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শান্ত্বনা দিয়ে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন- ‘কখনো তা হতে পারে না। আপনি শান্ত হোন। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্চিত অপদস্থ করতে পারেন না। কারণ-

>> আপনি সবসময় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আচরণ করেন। (তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন না বা অনাত্মীয় সূলভ আচরণ করেন না।
>> আপনি সবসময় সত্য বলেন।

>> আপনি অপরের বোঝা বহন করেন। (কর্জ প্রভৃতি শোধ করেন।)
>>নিঃস্বদের দেখাশোনা করেন।

>>অতিথিদের সেবা যত্ন করেন।
>> বিপদগ্রস্তদের সাহয্য করেন এবং সত্যের সহায়তা করেন’।

ওয়ারাকা ইবনে নাওফিলের কাছে

এভাবে শান্ত্বনা দেওয়ার পর খাজিদা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফিলের কাছে যান। ওয়ারাকা তখন অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তার কাছে খাজিদা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সবকিছু খুলে বললেন। সব শুনে ওয়ারাকা ইবনে নাওফিল বললেন-

‘ইনি হচ্ছেন সেই মহান ফেরেশতা যিনি মূসা আলাইহিস সালামের কাছে এসেছিলেন। হায় যদি আমি যুবক হতাম এবং ওই সময় পর্যন্ত জীবিত থাকতাম যখন আপনার স্বজাতি আপনাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে’।

একথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কি! তারা আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে?’

ওয়ারাকা ইবনে নাওফিল বললেন, জি। যখনই কোনো জনপদে কোনো রাসূল আল্লাহর একত্ববাদে দাওয়াত নিয়ে এসেছেন সেই জনপদের মানুষজন প্রথমে তার সঙ্গে শত্রুতাই করেছে।

ওয়ারাকা ইবনে নাওফিলের কাছ থেকে ফিরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারো হেরা গুহায় যাতায়াত করতে লাগলেন। কিছুদিন পর্যন্ত তার কাছে ওহী আসা বন্ধ ছিল। এ সময়টাকে ফাতরা বা বিরতিকাল বলা হয়ে থাকে।

অবশেষে একদিন হেরা গুহা থেকে বাড়িতে ফেরার পথে আবার তিনি জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখলেন। আবারো ঘাবড়ে গেলেন এবং ঘরে এসে বস্ত্রাবৃত হয়ে শুয়ে পড়লেন। এ সময় তার কানে গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলো-

یٰۤاَیُّہَا الۡمُدَّثِّرُ ۙ ١ قُمۡ فَاَنۡذِرۡ ۪ۙ ٢ وَرَبَّکَ فَکَبِّرۡ ۪ۙ ٣ وَثِیَابَکَ فَطَہِّرۡ ۪ۙ ٤ وَالرُّجۡزَ فَاہۡجُرۡ ۪ۙ ٥

হে বস্ত্রাবৃত! ওঠ এবং মানুষকে সতর্ক কর। এবং নিজ প্রতিপালকের তাকবীর বল (মহিমা ঘোষণা কর)। এবং নিজ কাপড় পবিত্র রাখ, এবং অপবিত্রতা হতে দূরে থাক। (সূরা মুদ্দাসসির, (৭৪), আয়াত, ১-৫)

এরপর ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ওহী আসতে থাকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। (ইসলামের ইতিহাস ১/৯০)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *