মুসাফিরের নামাজ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কথা
সফরে থাকলে কোরআনের হুকুম অনুযায়ী নামাজ কসর (সংক্ষেপ) করতে হয়। বিভিন্ন হুকুম-আহকাম পালনের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়।
মূলত ৪৮ মাইল বা ৭৮ কিলোমিটার দূরে ১৫ দিনের কম সময়ের জন্য সফরের নিয়তে নিজের বসবাসের স্থানের লোকালয় ত্যাগ করলে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে তাকে মুসাফির হিসেবে গণ্য করা হয়। ৪৮ মাইলের কম সফরের নিয়তে বের হলে অথবা ১৫ দিনের বেশি সময়ের জন্য সফর করলে মুসাফির হিসাবে গণ্য হয় না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১১৩৯, আসারুস সুনান ২৬৩)
সুতরাং কেউ ৪৮ মাইল সফরের নিয়তে বের হলো না, অথচ নিয়ত ব্যতীত সারা দুনিয়া ঘুরে এলো, সে মুসাফির হিসাবে গণ্য হবে না। (রদ্দুল মুহতার ২১২১)
মুসাফিরের ‘ওয়াতনে আসলি’ (মূল বাড়ি)
ওয়াতনে আসলি মানুষের এমন নিজস্ব বাসস্থানকে বলে যেখানে সে জন্মগ্রহণ করেছে কিংবা তার পরিবার বসবাস করে কিংবা সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করেছে।
(আদ্দুররুল মুখতার ২১৩১)
ওয়াতনে আসলির জন্য বাড়ি, জায়গা ও স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত জরুরি। (প্রাগুক্ত) ওয়াতনে আসলির হুকুম হলো, ওয়াতনে আসলিতে মানুষ মুকিম গণ্য হয়। সেখানে মুসাফিরের হুকুম চলে না।
একাধিক ওয়াতনে আসলি
ওয়াতনে আসলি একাধিক হতে পরে। যেমন কেউ নতুন করে শহরে বাড়ি করলো। আর পূর্ব থেকে তার গ্রামে বাড়ি রয়েছে। এখন সে যদি উভয় বাড়িতে আসা-যাওয়া করে এবং উভয়টিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করে তবে উভয়টি তার জন্য ওয়াতনে আসলি হবে। (আল-বাহরুর রায়েক ২১৩৬)।
মোটকথা ওয়াতনে আসলি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তির নিয়তই মূল। সে যদি দুটি স্থানকে ওয়াতনে আসলি বানায় এবং উভয়টিতে স্থায়ীভাবে থাকার নিয়ত করে (এখানে কিছু দিন ওখানে কিছু দিন) তবে উভয়টি তার জন্য ওয়াতনে আসলি গণ্য হবে। (ফাতাওয়া উসমানি ১৫৪৬)।
স্ত্রী যদি শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করে আর স্বামী তার কাছে বেড়াতে যায়, তাহলে সে সেখানে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে। তখন শ্বশুরালায় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি স্ত্রী স্বামীর বাড়িতে বসবাস করে আর বাপের বাড়িতে বেড়াতে যায়, তাহলে তার শ্বশুর বাড়িতে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে।
স্বামীর জন্য তার শ্বশুরালয়
সাধারণত তিন কারণে ওয়াতনে আসলি প্রমাণিত হয়। (১) জন্মস্থান (২) শ্বশুরালয় যদি সেখানে স্ত্রী বসবাস করে। (৩) অথবা এমন কোনো স্থান যেখানে স্বপরিবারে বসবাস করার জন্য নির্ধারণ করা হয়। তবে শ্বশুরালয় শুধু বিবাহ করলেই তার ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে না। বরং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করতে হবে। ফুকাহায়ে কেরামের বিভিন্ন উদ্ধৃতি দ্বারা এমনটাই বুঝে আসে। নিম্নে কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো।
এক. আল্লামা কাজিখান (রহ.) বলেছেন, ‘ওয়াতনে আসলি এমন স্থান, যেখানে জন্মস্থান হিসেবে বসবাস করছে অথবা জন্মস্থান নয়; তবে বিবাহ করে তাকে স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে। ’ (ফাতওয়ায়ে কাজীখান ১৮০)
দুই. আল্লামা ইবনে হুমাম (রহ.) বলেন, ‘ওয়াতনে আসলি বা স্থায়ী বাসস্থান হলো, জন্মস্থান বা বিবাহ করে যেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ইচ্ছা রয়েছে। ’ (ফাতহুল কাদির ২১৬)
তিন. হজরত উসমান (রা.) মক্কা সফরে পূর্ণ চার রাকাত নামাজই পড়তেন। লোকেরা এতে বিরক্ত হলে তিনি বলেন, আমি মক্কা শরিফ বিবাহ করেছি আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কোনো শহরে বিবাহ করল সে সেখানে মুকিমের ন্যায় নামাজ পড়বে। ’ (মুসনাদে আহমাদ ১৬২)
উপরযুক্ত উদ্ধৃতিগুলো দ্বারা বোঝা যায়, শুধু বিবাহ করলেই সেখানে মুকিম হবে না। বরং তাকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের নিয়ত করতে হবে। এজন্যই আল্লামা কাজিখান ‘তাকে স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে নিয়েছে’ ও আল্লামা ইবনে হুমাম (রহ.) ‘সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছা রয়েছে’ শর্ত জুড়ে দিয়েছেন।
আর হজরত উসমান (রা.) যে মক্কা সফরে দুই রাকাত পড়তেন তার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে ‘কিফায়া’ নামক কিতাবে। সেখানে বলা হয়েছে, হজরত উসমান (রা.) এর এক পরিবার ছিল মক্কায়, আরেক পরিবার ছিল মদীনায়। তাই উভয় স্থানে তিনি মুকিমের মতো নামাজ পড়তেন। (কিফায়া ২১৭)
শুধু শ্বশুরালয় হলেই যদি মুসাফির হয়ে যেত তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন ও বিদায় হজের দিন কসর পড়তেন না। কেননা সেখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুই স্ত্রী সাওদা (রা.) ও মাইমুনা (রা.) এর পিত্রালয় ছিল। অথচ সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় কসর পড়েছেন। (ইমদাদুল আহকাম ১৬০৪)
এ বিষয়ে আরও কিছু ফতওয়ার কিতাবের উদ্ধৃতি—
(১) আল্লামা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.) লেখেন, বিবাহের পর স্ত্রীকে শ্বশুরালয়ে না রেখে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসলে স্ত্রীর পিত্রালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলি গণ্য হবে না। স্বামী সেখানে গেলে মুসাফির হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি স্ত্রীকে তার পিত্রালয়ে বসবাসের নিয়তে রাখে তাহলে স্ত্রীর পিত্রালয় স্বামীর জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। (ইমদাদুল আহকাম ১৬০৫)
(২) মুফতি আজিজুর রহমান (রহ.) লেখেছেন, বিবাহের স্থান ওয়াতনে আসলি হিসেবে কেবল তখনই গণ্য হবে যখন যেখানে স্বপরিবারে থাকার ইচ্ছা থাকে। এমন নয় যে, বিয়ের পর স্ত্রীকে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে আসার পর ও স্বামীর জন্য শ্বশুরালয় ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। (ফাতওয়ায়ে দারুল উলুম ৪৪৮৩)
স্ত্রীর জন্য তার বাপের বাড়ি
বিবাহের পর স্ত্রীর জন্য তার বাপের বাড়ি ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য। যদিও সে স্বামীর সংসারে চলে যায়। কেননা এটা তার জন্মসূত্রে ওয়াতনে আসলি এবং নতুন যে বাড়িতে সে বসবাসের জন্য উঠবে সে বাড়িও তার ওয়াতনে আসলি। ওয়াতনে আসলি দ্বারা ওয়াতনে আসলি বাতিল হয় না। তবে যদি দুটি ওয়াতনে আসলি কোনো একটি পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করার ইচ্ছা করে তাহলে সে ক্ষেত্রে ওয়াতনে আসলি বাতিল হয়ে যাবে। সুতরাং নিজের বাসস্থানের বাড়ি বা বাপের বাড়ি কোনো একটি যতক্ষণ না পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ করার ইচ্ছা না করে ততক্ষণ সেই বাড়ি তার ওয়াতনে আসলি হিসেবে বহাল থাকবে। ব্যাপারে ইবনে হুমাম (রহ.) বলেন, ‘কেউ যদি একটি বাসস্থান গ্রহণ করার পর সেটি পরিত্যাগ করে অন্য আরেকটি বাসস্থান গ্রহণ করে তাহলে প্রথম বাসস্থান তার জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে বহাল থাকে না। তবে যদি সে কোনোটিই পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাগ না করে তবে উভয়টিই তার জন্য ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য হবে। (ফাতহুল কাদির ২১৬)
ওয়াতনে আসলি ত্যাগ করা ব্যতীত অন্য আরেকটি ওয়াতনে আসলি গ্রহণ করলে প্রথমটি ওয়াতনে আসলি বাতিল হয় না। (ফাতহুল কাদির ২১৬)
আল্লামা নুজাইম (রহ.) স্বীয় গ্রন্থ আল বাহরুরায়েক বলেন, একটি একটি ওয়াতনে আসলি কেবলমাত্র আরেকটি ওয়াতনে আসলি দ্বারাই বাতিল হয়। অন্য কোনো বাসস্থান দ্বারা নয়। অর্থাৎ অন্য কোনো বাসস্থান তৈরি করে সেখানে নতুন করে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিলেই প্রথম বাসস্থানটি ওয়াতনে আসলি হিসেবে বাতিল হবে। পরে পুরাতন বাসস্থানে গেলে নামাজ কসর করবে। আর যদি পূর্বের বাসস্থানটি পরিপূর্ণভাবে ত্যাগ না করে তাহলে পুরাতন বাড়ি গেলে সেখানে সে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে। (আল বাহরুর রায়েক ২১৩৬)
তবে কোনো নারী পিত্রালয়কে পরিপূর্ণভাবে ত্যাগ করে না। বরং পিত্রালয়কেই তার আসল বাড়ি মনে করে। এ জন্যই কোনো কারণে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাহলে তাদেরকে পিত্রালয়ে আসতে দেখা যায়। আমাদের সমাজের রীতিনীতি অনুযায়ী স্ত্রীর পিত্রালয়কেই তার আসল বাড়ি গণ্য করা হয়। এই সামাজিক রীতি-নীতিকে শরিয়তের পরিভাষায় উরফ বলা হয়। উরফ ও শরিয়তের একটি দলিল। এ বিষয়ে আল্লামা শামি (রহ.) বলেন, ‘উরফ ও আদাত তথা প্রচলিত রীতিনীতি শরিয়তে গ্রহণযোগ্য, যদি তা শরিয়ত পরিপন্থি না হয়। এর ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য মাশাআল্লাহ প্রণীত হয়। এ জন্যই শরিয়তবিদরা উরফ ও আদাতকে একটি মূলনীতি হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। (শরহে উকুদে রসমিল মুফতি ৩৭)
এছাড়াও বহু ফিকহের কিতাবে স্ত্রীর পিত্রালয়কে স্ত্রীর ওয়াতনে আসলি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফতওয়ায়ে কাজীখানের এক স্থানে বলা হয়েছে, ‘ওই মহিলাও মুসাফির গণ্য হবে যাকে তার স্বামী সফর অবস্থায় তালাক দিয়েছে। এমতাবস্থায় তার ইদ্দত ও শেষ হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে মুফতি আব্দুর রহীম লাজপুরী রহ বিবাহের পর স্ত্রী স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে সে সেখানে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে এবং পূর্ণ নামাজ পড়বে। তেমনি পিত্রালয়ে গেলেও পূর্ণ নামাজ পড়বে। কেননা সে পিত্রালয় সম্পূর্ণ ত্যাগ করে চলে আসেনি। স্বামী শ্বশুরালয়ে গেলে মুসাফির হিসেবে নামাজ পড়বে। (যদি নিজ বাড়ি থেকে শ্বশুরালয় ৪৮ মাইল বা ৭৭.২৫ কিলোমিটার অথবা ততোধিক দূরবর্তী হয়। হ্যাঁ, স্ত্রীকে শ্বশুরালয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে মুকিম হিসেবে গণ্য হবে এবং পূর্ণ নামাজ পড়বে। (ফাতওয়ায়ে রহিমিয়্যাহ ৫১০)