অন্যান্য

যে মেলায় খাসির দামে মিলছে ঘোড়া

গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম গ্রাম্য মেলা। গ্রামীণ ঐতিহ্যের সার্বিক রূপরেখা ফুটে ওঠে এসব মেলায়। নাগরদোলা, সুস্বাদু জিলাপি, পুতুল নাচসহ নানা আয়োজন থাকে মেলায়। আরও থাকে গবাদি পশু বিক্রির ব্যবস্থা।

দিনাজপুরের সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের বাংলাদেশ চেরাডাঙ্গী মেলা। যেটি সবার কাছে পশু মেলা হিসেবেও পরিচিত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের ঘোড়া এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ। যদিও কালের বিবর্তনে কমেছে এ মেলার পরিধি। মেলায় ঘোড়ার সংখ্যা কমার পাশাপাশি কমেছে ঘোড়ার দামও। ভালো মানের একটি খাসির দামে মিলছে ঘোড়া। আট হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঘোড়া দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা।

দিনাজপুর সদর উপজেলার কোমলপুর এলাকার ঘোড়া বিক্রেতা শাহ আলম বলেন, ছয় মাস আগে ঘোড়া কিনেছিলাম। এখন তো মাঠের ঘাস তেমন নাই। গরু ছাগলের মতো খাবার কিনে ঘোড়াকে খাওয়াতে হয়। মাত্র ১২ হাজার টাকায় ঘোড়াটা বিক্রি করে দিলাম। এত খাওয়ানোর পরেও দাম পাইলাম না। ১২ হাজার টাকা তো একটা খাসির দাম। খাসির দামে ঘোড়া বিক্রি করলাম। এতে আমার অনেক লোকসান হলো।

জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দরের ঘোড়া বিক্রেতা রিয়াজউদ্দিন বলেন, মেলায় ঘোড়ার ক্রেতার সংখ্যা অনেক কম। ঠিকমতো ক্রেতা থাকলে যে ঘোড়ার দাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাম হতো সেই ঘোড়ার দাম বলতেছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। মাঠে ঘাস নেই, ক্যানেলগুলোতেও আর ঘাস হয় না। খাবার কিনে খাওয়াতে হয়। এ জন্য ক্রেতার সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে একটা খাসি কিনতে গেলেও ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার বেশি লাগে। সেই অনুযায়ী তো একটা খাসির দামেও ঘোড়া বিক্রি করতে পারছি না।

সদর উপজেলার মহিষকোঠা এলাকার হাসিনুর ইসলাম। মেলা ঘুরে ১২ হাজার টাকায় পছন্দের ঘোড়া কিনেছেন তিনি। কথা হলে তিনি বলেন, মানুষের তো অনেক ধরনের শখ থাকে। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল একটা ঘোড়া কেনার। আজকে ১২ হাজার টাকায় একটা লাল রঙের ঘোড়া কিনলাম। একটা ছাগল কিনতে গেলে এর চেয়ে বেশি দাম লাগে। শখ তো লাভ লোকসান চিন্তা করে হয় না।

তবে ভালো জাতের ঘোড়ার ভালো দাম আছে বলে জানান অনেক বিক্রেতা। রংপুরের বদরগঞ্জ থেকে ঘোড়া বিক্রি করতে চেরাডাঙ্গী মেলায় এসেছেন আক্তারুজ্জামান। তিনি বলেন, আমার দাদা থেকে বাবা তারপর আমি। আমরা সবাই বংশীয়ভাবেই ঘোড়া পালন করি। যদিও বা আগের মতো ঘোড়ায় লাভ হয় না। তবুও ভালো জাত ও মানের ঘোড়ার ভালো দাম আছে। এখানে ১০ হাজার টাকায় ঘোড়া বিক্রি হচ্ছে। আবার দেড় লাখ টাকা দামেরও ঘোড়া আছে। যে ঘোড়া ভালো দৌড়ায়, কায়দা কানুন ভালো রপ্ত করতে পারে সেই ঘোড়ার দাম সবসময় বেশি হয়।

নওগাঁর সাপাহার এলাকা থেকে আটটি ঘোড়া বিক্রি করতে এসেছেন মোস্তাকিম। তার পালনকৃত একটি ঘোড়ার নাম নিউ রাজা। কথা হলে তিনি বলেন, ঘোড়ার খাবারের দাম বেড়েছে অনেক। মাঠেও ঘাসপালা নেই। এসব হিসেব করলে ঘোড়া পালন লোকসান হবে। কিন্তু আমার যখন ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় যাই আর সবার ঘোড়াকে হারিয়ে আমাদের ঘোড়া প্রথম তখন আমাদের অনেক ভালো লাগে। আর দৌড় প্রতিযোগিতার ঘোড়ার দামও ভালো পাওয়া যায়।

এদিকে ঘোড়া আর ঘোড়দৌড় দেখতে অনেক লোকজনের ভিড় হয় চেরাডাঙ্গী মেলায়। অনেকেই পরিবার নিয়ে আসেন ঘোড়া দেখতে। দর্শনার্থীরা জানান, চেরাডাঙ্গী মেলা অনেক পুরাতন একটি মেলা। এখানে অনেক দূরদূরান্ত থেকে ঘোড়া বিক্রি করতে আসেন। শিশুরা এখানে ঘোড়া দেখে অনেক আনন্দ পায়। এই মেলাগুলো গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বহন করে।

বাংলাদেশ চেরাডাঙ্গী মেলা কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকে চেরাডাঙ্গী মেলা চলে আসছে। এখানে আশেপাশের লোকজন তাদের উৎপাদিত পণ্য, গবাদি পশু বিক্রি করে থাকে। এখানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজন ঘোড়া ক্রয় বিক্রয়ের জন্য আসেন। আমরা মেলা কমিটির পক্ষ থেকে তাদের পানি, থাকার ক্যাম্প, বাতিসহ সার্বিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকি। প্রতি বছর ২৩ মাঘ এ মেলার উদ্বোধন হয়ে থাকে। এটি আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি মেলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *