চট্টগ্রাম

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে কুয়া

২০১০ সালে দেশে পানীয় জলের উৎস হিসেবে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ কুয়া ব্যবহার করতেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপেও কুয়া হারিয়ে যাওয়ার চিত্র স্পষ্ট।

চট্টগ্রাম শহরে নব্বইয়ের দশক থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে কুয়া। তবে হারিয়ে যাওয়ার এই যাত্রার মধ্যেও কিছু কিছু কুয়া এখনও রয়ে গেছে।

পাঁচলাইশ থানাধীন হামজারবাগ রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এলাকায় শতবর্ষী একটি কুয়া এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা পূরণ করছে। এখানকার ৫-৭ হাজার মানুষ এই কুয়ার পানির ওপর নির্ভরশীল। প্রায় সাড়ে ৪ বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন স্থানীয় মানুষের চাহিদার প্রেক্ষিতে অর্ধলাখ টাকা ব্যয়ে এই কুয়া সংস্কার করে দেয়।

৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবারক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রহমান নগর, হিলভিউ কলোনি, হামজারবাগ কলোনিসহ আশপাশের এলাকার প্রায় ৭ হাজার মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে আসছে ৩০০ ফুট গভীর এই কুয়া। কুয়ার পাড় ও চারদিকে টাইলস দিয়ে দুই দফায় আধুনিকায়ন করা হয়েছে। মানুষ এখানে গোসলও করছে। তবে গোসল করা ও কাপড় ধোয়া নিষিদ্ধ। কুয়াটি এই এলাকার ঐতিহ্য।

তিনি জানান, পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ড এলাকায় একসময় ৬-৭টি কুয়া ছিল। এখন ৩টি টিকে আছে। এর মধ্যে রেলবিট এলাকায় একটি এবং ৫০ গজের মধ্যে আরও একটি কুয়া থাকলেও সেগুলো ব্যবহার উপযোগী নয়।

এখানে কুয়া থেকে পানি নিতে এসে ষাটোর্ধ্ব মায়মুনা খাতুন বলেন, এই কুয়ার পাড় থেকেই প্রতিদিন ১০ সদস্যের পরিবারের পানির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। গোসল করা ও পানি নিতে সবসময় ভিড় থাকে।

নগরের সিরাজউদ্দৌলা রোড মাছুয়া ঝর্ণা কুয়ার পাড়ে গিয়ে খুঁজলেও মিলবে না কুয়ার দেখা। ঘাটফরহাদবেগ এলাকায় দেওয়ানবাজার ওয়ার্ড অফিসের পাশের কুয়া, পাথরঘাটা সতীশ বাবু লেনের মুখে থাকা কুয়া, ফিরিঙ্গিবাজার জেএম সেন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের কুয়া, হাজারী গলি কে সি দে রোডের মুখের কুয়া, হালিশহরের কুয়া, পলোগ্রাউন্ড রেলওয়ে কলোনির কুয়া হারিয়ে গেছে। এক দশক আগেও এসব কুয়া ঘিরে জমতো মানুষের ভিড়।

পলোগ্রাউন্ড রেলওয়ে কলোনির বাসিন্দা সাহেদ নিজাম বলেন, ৬০-৭০ বছর আগে কলোনির মানুষের ব্যবহারের জন্য এখানে কুয়া খনন করা হয়েছিল। ১০ বছর আগেও সেটি সবাই ব্যবহার করতো। পান করতো কুয়ার পানি। এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে।

জামালখানে শত বছরের পুরোনো দুটি কুয়া এখনও দৃশ্যমান। একটি লিচুবাগান এলাকায় এবং আরেকটি জামালখান বাইলেইন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে। লিচুবাগান কুয়ার পাড়ে গড়ে ওঠা খাবারের দোকান থেকে উচ্ছিষ্ট ও ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় কুয়ায়।

মাটির উপরি স্তর থেকে স্বচ্ছ জলের স্তর পর্যন্ত গভীরে খোঁড়া গোলাকার কূপ থেকেই কুয়া নামের উৎপত্তি। কুয়ার সমার্থক শব্দ ইঁদারা। এর অপভ্রংশ রূপ ‘ইন্দিরা’। বাংলায় ‘পাত’ শব্দটি ‘ছোট’ অর্থে ব্যবহার হয়। এই পাতের সঙ্গে কুয়া শব্দ যোগ হয়ে পাতকুয়া শব্দটি এসেছে। সাধারণত পানীয় জলের অগভীর কূপই পাতকুয়া। এই অগভীরে খোঁড়া গোলাকার গর্তের ভেতরে বালি-পাথর ও সিমেন্টের তৈরি কিংবা পোড়ামাটির তৈরি গোলাকার পাট, কখনও বাঁশের তৈরি খাঁচা বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

জানা যায়, সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার্থে পাতকুয়া খনন করা হয়। পরবর্তীতে শের শাহ’র আমল ও মোগল আমলে মুসাফির ও পথিকদের জন্য মহাসড়কের পাশে এবং বসত এলাকার পাড়ায় পাড়ায় মানুষের জন্য একটি করে পোড়ামাটির বেষ্টনি দেওয়া কুয়া নির্মাণ করা হয়। বিংশ শতকের আশির দশক পর্যন্ত ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উদ্যোগে জেলার জনবহুল অঞ্চলে পাতকুয়া বসানো হতো। নব্বই দশকের প্রথম থেকেই নলকূপের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে কুয়ার ব্যবহার কমে আসে।

১৮৬৩ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পৌর এলাকার মানুষের পানি সরবরাহের একমাত্র মাধ্যম ছিল কুয়া। এখন প্রত্যন্ত পল্লীতেও কুয়ার দেখা মিলে না। গভীর-অগভীর নলকূপ দখল করে নিয়েছে কুয়ার জায়গা।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কুয়ার ধারে’ কবিতায় লিখেছেন- ‘তোমার কাছে চাইনি কিছু, জানাইনি মোর নাম- তুমি যখন বিদায় নিলে, নীরব রহিলাম। একলা ছিলেম কুয়ার ধারে- নিমের ছায়াতলে, কলস নিয়ে সবাই তখন পাড়ায় গেছে চলে। আমায় তারা ডেকে গেল, আয় গো, বেলা যায়। কোন্ আলসে রইনু বসে- কিসের ভাবনায়’।

গবেষক ড. সাইফুল আলমের মতে, কুয়া নগরের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি পানিরও জোগান দেয়। এখনও যেসব কুয়া টিকে আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা গেলে মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *