দেশজুড়ে

রাতে আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’, উপকূলজুড়ে প্রস্তুতি

তিনদিন ধরে সাগরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকা ঘূর্ণিবায়ুর চক্রটি শনিবার সন্ধ্যায় গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। তখন এর নাম দেওয়া হয় ‘রেমাল’।

রোববার (২৬ মে) দুপুরে এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। আর আজ রাতে আঘাত হানবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে।

ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার গতির বাতাসের শক্তি নিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’। ঝুঁকিতে থাকা এলাকার বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে উপকূলীয় জেলাগুলোতে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। স্বেচ্ছাসেবীরা লাল পতাকা নিয়ে নেমে পড়েছেন মাঠে। হ্যান্ড মাইকে তারা মানুষকে সতর্ক করছেন, নিচু এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলছেন।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ‍গুছিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে শনিবার দিনের বেলা থেকেই। ভারি বর্ষণে ভূমি ধসের শঙ্কা থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকেও বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সর্তক সংকেত নামিয়ে তার বদলে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়। আর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়।

শনিবার বিকেলে উপকূলীয় জেলাগুলোতে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর রাতে গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিলে ঢাকা থেকে অভ্যন্তরীণ নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বাতিল করা হয় কক্সবাজার ও কলকাতা রুটের বিমানের ফ্লাইট।

শনিবার মধ্যরাতে আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়, উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় রেমাল উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে।

ওই সময় ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ৩৪০ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিল।

ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ছিল ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠী, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরের নিমাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩-৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাসে প্লাবিত হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সারাদেশে দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ ভারি (৪৪ থেকে ৪৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারি (৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বৃষ্টি হতে পারে।

আঘাত হানবে কখন, কোথায়?

ভারতের আলীপুর আবহাওয়া অফিসের বুলেটিনে বলা হয়েছে, বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে হতে আরও ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়টি রোববার দুপুরের দিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিতে পারে। বর্তমান গতিপথ অব্যাহত থাকলে রোববার মধ্যরাতের দিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল বাংলাদেশের খেপুপাড়া ও ভারতের সাগর দ্বীপের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার থাকতে পারে, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৩৫ কিলেমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে।

এর সঙ্গে ভারি বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাস থাকবে। খুলনা ও সুন্দরবন থেকে শুরু চট্টগ্রাম পর্যন্ত উপকূলীয় সব জেলায় ঝড়ের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলাকে বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য উপকূলীয় জেলাতেও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে।

এদিকে উপকূলীয় জনগণের মাঝে সচেতনতার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। এজন্য এ বাহিনীর সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছে। উপকূল ছাড়াও চরাঞ্চলের লোকজনকে সচেতন, ঝড় পরবর্তী আক্রান্তদের উদ্ধার ও মেডিকেল সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে রেসকিউ ও মেডিকেল টিমের সদস্যরা।

শনিবার (২৫ মে) রাতে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লে. কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করছে। ঘূর্ণিঝড়ের বিপদজনক পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার জন্য নিকটবর্তী সাইক্লোন সেল্টার স্টেশনে আশ্রয় গ্রহণের প্রস্তুতির জন্য সকলকে সচেতন করা হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, এছাড়া মংলা, খুলনা, ভোলাসহ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকাগুলোতে চরাঞ্চলের মানুষজনকে সচেতন করে প্রচারণা চালানো হয়েছে। যারা আক্রান্ত হবেন তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য উদ্ধারকারী দল এবং উদ্ধার পরবর্তী সময় চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য আমাদের মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে।

এছাড়া ‘রেমাল’ মোকাবেলার কাজ সমন্বয় করতে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং সেল খুলেছে ফায়ার সার্ভিস। সংস্থাটির খুলনা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। এসব বিভাগের খোলা হয়েছে বিভাগীয় মনিটরিং সেল।

সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জনসাধারণকে সচেতন, সতর্ক ও সাবধান করছে সেই সমস্ত এলাকার ফায়ার স্টেশনগুলোর কর্মীরা। শনিবার দুপুরের পর থেকে সচেতনতা সৃষ্টির এই প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়-পূর্ব, ঘূর্ণিঝড় সময়কালীন এবং ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সকল কাজ সমন্বয় করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে সদর দপ্তর ঢাকায় খোলা হয়েছে মনিটরিং সেল।

এতে বলা হয়, উপকূলীয় এলাকার সকল ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রতি ফায়ার স্টেশনে ফায়ারফাইটিং টিম, সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ টিম, প্রাথমিক চিকিৎসাকারী দল এবং ওয়াটার রেসকিউ টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এছাড়া ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী অনুসন্ধান ও উদ্ধারকাজসহ রাস্তাঘাট যান চলাচল উপযোগী করার কাজে ফায়ার সার্ভিস নিয়োজিত থাকবে। তাদের সাথে সহযোগিতা করবেন ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়াররা। এসব এলাকায় জীবন ও মালামাল সুরক্ষা সংক্রান্ত যেকোনো কাজে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ফায়ার সার্ভিসের সেবা নেওয়া যাবে।

সকল আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রয়োজনে উপকূলবর্তী ফায়ার স্টেশনগুলোতেও সাধারণ জনগণ আশ্রয় নিতে পারবেন।

যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিসের নিকটবর্তী ফায়ার স্টেশন, বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হটলাইন নম্বর ১৬১৬৩ অথবা কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল-এর জরুরি মোবাইল নম্বর ০১৭৩০৩৩৬৬৯৯-এ ফোন করার জন্য সকলকে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *