চট্টগ্রাম

শিশুর বেসরকারি টিকার পেছনেই বাড়তি খরচ

শিশুদের বিভিন্ন সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য সম্প্রসারিত টিকাদান (ইপিআই) কর্মসূচির আওতায় দেওয়া হয় বিভিন্ন রোগের ৬টি টিকা। নামমাত্র মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে এসব টিকা পাওয়া গেলেও আরও কিছু রোগের টিকা ব্যক্তিগতভাবে কিনতে হয়।

ইপিআই কর্মসূচির অধীনে যক্ষা প্রতিরোধে বিসিজি টিকা, পোলিও রোধে ওপিভি টিকা, ডিপথেরিয়া-হুপিংকাশি-ধনুষ্টংকার-ইনফ্লুয়েঞ্জা-হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে পেন্টাভ্যালেন্ট টিকা, নিউমোনিয়া রোধে পিসিভি, হাম ও রুবেলা রোধে এম আর টিকা, ধনুষ্টংকার রোধে দেওয়া হয় টিটি। এছাড়া রাতকানা রোগ ও মৃত্যুহার হ্রাসে খাওয়ানো হয় ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল।

বেসরকারিভাবে চিকিৎসকদের পরামর্শে দেড় মাস বয়সে কলেরার টিকা, ১২ মাস বয়সে চিকেন পক্স এর টিকা, ১৮ মাস হলে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং দুই বছর বয়সে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া হয়। বলা হয়- ডায়রিয়া, মেনিনজাইটিস এবং জলাতঙ্কের টিকাও তালিকায় যুক্ত করতে। এতে শুধু টিকার পেছনেই অভিভাবকদের খরচ করতে হয় বাড়তি টাকা।

ইনসেপ্টার কলেরার টিকা চোলভ্যাক্স ১ হাজার টাকা, চিকেন পক্স এর টিকা ভেরিজোস্ট ১৪০০ টাকা, হেপাটাইটিস ‘এ’ এর টিকা প্রিভেলহেভ ৬০০ টাকা, টাইফয়েডের টিকা ভ্যাক্সফয়েড ৫০০ টাকা বিক্রয়মূল্য হলেও দাম নেওয়া হয় দ্বিগুণ বা তারও বেশি। এছাড়া ডায়রিয়ার টিকা রোটা টেকের দাম প্রতি ডোজ ১৬০০ টাকা, রোটা রিক্স প্রতি ডোজের দাম ১৮০০ টাকা, রোটাভেক্স ১৫০০ টাকা। জলাতঙ্কের টিকা র‌্যাবিক্স এর দাম ৫০০-১ হাজার টাকা।

ব্যাকটেরিয়াল মেনিনজাইটিস প্রতিরোধে তিন ধরনের টিকা পাওয়া যায়- মেনিগোকক্কাল মেনিনজাইটিস, নিউমোকক্কাল মেনিনজাইটিস এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিউমোকক্কাল মেনিনজাইটিস এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি-এর টিকা শিশুদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়। মেনিগোকক্কাল মেনিনজাইটিসের টিকা বেসরকারিভাবে হাসপাতাল, ভ্যাকসিন সেন্টার ও চিকিৎসকের চেম্বারে পাওয়া যায়। এই রোগের ইনগোভ্যাক্স নামের টিকার দাম ১ হাজার টাকা। কোম্পানিভেদে কোনও কোনও টিকার দাম নেওয়া হয় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।

চিকিৎসকরা বলছেন, টাইফয়েড এর টিকা দেওয়াটা এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানিবাহিত রোগ টাইফয়েডের অন্যতম কারণ-দূষিত খাবার গ্রহণ। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে এই রোগের জীবাণু ছড়ায়। রক্তক্ষরণ, অগ্নাশয়ে প্রদাহ, মেরুদণ্ডে সংক্রমণ এমনকি কিডনিতেও বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে টাইফয়েড থেকে।

বর্তমানে দুই ধরনের টাইফয়েড এর টিকা দেশে পাওয়া যায়-টাইফয়েড পলিস্যাকারাইড টিকা এবং টাইফয়েড কনজুগেট টিকা। সাধারণত টাইফয়েড টিকা ২ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জন্য সুপারিশ করা হয়। এটি প্রতি ৩ বছর পরে পুনরাবৃত্তি করতে হয়। বিকল্পভাবে টাইফয়েড কনজুগেট টিকা বা টিসিভি শিশুকে ৬ মাসের পর থেকে দেওয়া যায়। টিসিভির বুস্টার ডোজ দেওয়ার দরকার হয় না।

অপরদিকে বাংলাদেশে গত দুই বছর ধরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা মশাবাহিত রোগ ‘জাপানিজ এনসেফালাইটিস’ শিশুদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে। কিউলেক্স মশার মাধ্যমে ছড়ানো এই ভাইরাসে শিশুদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি। এতে শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা তৈরি হয়, বার বার খিঁচুনি হয়, অনেকে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।

জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৬৪টি জেলার ৩৬টিতে এই রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। আইসিডিআরবি’র প্রতিবেদন বলছে, আক্রান্ত রোগীদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, রোগটির মৃত্যুহার ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, আক্রান্ত ১০০ জনের ৩০ জনই মারা যায়। সব বয়সের মানুষের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও ১৫ বছর বা এর চেয়ে কম বয়সের শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার বেশি। প্রতি চারজন রোগীর মধ্যে তিনজনের বয়স ১৫ বছর বা এর চেয়ে কম। যেহেতু শিশুরা বাইরে খেলাধুলা করে, ফলে তারা সহজেই মশার সংস্পর্শে বেশি আসে।

এ অবস্থায় ২০২৫ সালে ইপিআই কর্মসূচিতে টাইফয়েড কনজুগেট টিকা ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস টিকা সংযোজন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। টাইফয়েড সংক্রমণের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের জন্য টাইফয়েড এর টিকা দিতে খরচ করতে হয় আড়াই-তিন হাজার টাকা। রেনাটা কোম্পানির টাইফয়েড কনজুগেট টিকার দাম বর্তমানে আড়াই হাজার টাকা। শিশুর ৬ থেকে ৯ মাস বয়সের মধ্যে একটি একক ডোজ গ্রহণ করতে হয়। এ সময়ের মধ্যে টিকা দেওয়া না গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হয়।

এছাড়া জাপানিজ এনসেফালাইটিস টিকা সাধারণত দুই মাস ও তার বেশি বয়সী শিশুদের দিতে বলা হয়। দেশে এখনও এই টিকার বহুল প্রচলন নেই। সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারজাতকৃত ভারতীয় ইমোজেভ টিকা কিনতে খরচ হয় আড়াই হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরীর মতে, শিশু বয়সে প্রতিরোধমূলক টিকা ব্যবহারের মাধ্যমে বেশকিছু ভাইরাসজনিত এনসেফালাইটিস থেকে শিশুকে সুরক্ষা দেয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মিজেলস, মাম্পস, রুবেলা, জাপানিজ এনসেফালাইটিস প্রভৃতি রোগের প্রতিষেধক টিকা।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, টিকা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি স্বর্গীয় অনবদ্য উপহার। শিশুদের জন্মগত ইমিউন সিস্টেম ও মায়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশিরভাগ জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করতে পারলেও, কিছু কিছু গুরুতর রোগ আছে যার থেকে তারা সুরক্ষিত থাকে না। তাই তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করার জন্য টিকা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, পৃথিবীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে ইপিআই টিকাদান কর্মসূচি সাফল্যজনকভাবে পালন করে শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে আনতে পেরেছে। সরকার ইপিআইয়ের মধ্যে অতি জরুরি ১০টি রোগের টিকা দিচ্ছে। এর সঙ্গে টাইফয়েড কনজুগেট টিকা ও জাপানিজ এনসেফালাইটিস টিকা সংযোজন করার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *