হত্যা নাকি অন্যকিছু; জানা যায়নি দুই মাসেও
চট্টগ্রাম নগরের হোটেল পেনিনসুলা থেকে বিদেশি নাগরিকের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় পেরিয়ে গেছে দুই মাস। কিন্তু নেই মামলার অগ্রগতি। হত্যা নাকি অন্যকিছু— এমন কোনো ক্লু এখনো বের করতে পারেনি পুলিশ। সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্ট এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্টের দিকে পুলিশের চোখ। ৫৮ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি বহুজাতিক ফ্যাশন রিটেইলার প্রতিষ্ঠান বিগ স্টার লিমিটেডে ‘কোয়ালিটি কন্ট্রোলার’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সিভয়েস২৪ এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৪ মার্চ মরদেহ উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করে। এরপর ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পাঠায়। সেখানে ফরেনসিক কেমিক্যাল টেস্টিং শেষে গত ২১ মার্চ রেজিস্ট্রি ডাকযোগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ঠিকানায় রিপোর্টটি পাঠানো হয়েছে। যার স্মারক নম্বর–৮৭৯ এবং রিপোর্ট নম্বর–২৭০। অন্যদিকে পোস্টমর্টেম রিপোর্টও প্রস্তুত হয়ে আছে।
কিন্তু এখনো পুলিশের হাতে এসব রিপোর্ট এসে পৌঁছেনি। এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ ‘মুখ’ খুলছে না। পুলিশ ‘গৎবাঁধা’ বক্তব্যে রিপোর্ট হাতে না পাওয়ার কথা জানালেও চমেক ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সুমন মুৎসুদ্দি ওই বিষয়ে কথাই বলতে রাজি নন।
গত ৪ মার্চ হোটেল পেনিনসুলার ৯ম তলার ৯১৫ নম্বর কক্ষ থেকে পোল্যান্ডের নাগরিক জিদজিসোয়াহ মিশেল জেরিবার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় তাঁর মাথার পেছনে ‘দুটি রক্তাক্ত আঘাতের চিহ্ন ছিল। তাছাড়া তাঁর বিছানা, বালিশ রক্তে ভেজা এবং টয়লেট ও ফ্লোর রক্ত মাখা ছিল।’ ঘটনাস্থল থেকে ১৬ ধরনের আলামত জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় ওইদিন দিবাগত রাতে (৫ মার্চ) চকবাজার থানায় একটি ‘হত্যা মামলা’ দায়ের করেন বিগ স্টার লিমিটেডের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার পার্থ প্রতীম ঘোষ।
প্রথমে মামলাটির তদন্তভার পান চকবাজার থানার উপ-পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মনজুরুল আলম ভূঞাঁ। গত ২০ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। এই ৪৭ দিনে তিনি মামলার কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি জানাতে পারেননি। ৩৬ দিনের উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন।
পরে ২১ এপ্রিল মামলার তদন্তভার পান একই থানার উপ-পরিদর্শক মো. শফি উল্লাহ। মামলার অগ্রগতি এবং মৃত্যুরহস্য নিয়ে তাঁর কাছ থেকেও কিছু জানা যায়নি। সিভয়েস২৪-কে তিনি বলেন, ‘সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্ট এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি। রিপোর্ট দুটি পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।’
মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘বিদেশি (পোল্যান্ড) নাগরিক হত্যা মামলাটি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। মরদেহের ফরেনসিক রিপোর্ট এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসেনি এখনো। তাই মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’ রিপোর্ট দুটি এলে মৃত্যুরহস্য উদঘাটন হবে বলে মনে করছেন তিনি।
মামলার পুরো বিষয়টি দেশটির দূতাবাসের মাধ্যমে নিহতের পরিবার তদারকি করছে বলে জানা গেছে। পোল্যান্ডের প্রসিকিউটরের মাধ্যমে নতুন দিল্লির পোল্যান্ড দূতাবাসের সহায়তায় বাংলাদেশের সাথে মামলার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছেন তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে বিগ স্টার লিমিটেডের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার পার্থ প্রতীম ঘোষ বলেন, ‘আমাদের রেসপন্সিবিলিটি ছিল মরদেহ রিসিভ করে সেটি পরিবারের কাছে পাঠানো। আমরা সেটি করেছি। এখন মামলা সংক্রান্ত বিষয়গুলো পরিবার দেখছে। এক্ষেত্রে আমাদের কোম্পানির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে। পুরো বিষয়টি এখন তার পরিবার দেশটির দূতাবাসের মাধ্যমে তদারকি করছে।’
এদিকে দ্রুত মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘বিজিএমইএ সবসময় চায় সব বিদেশি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকুক। এ ধরনের ঘটনা পোশাকশিল্পের জন্য খারাপ। সুষ্ঠু ও দ্রুততার সাথে তদন্ত না করলে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে ইমেজ সংকটে পরবে।’
‘আমাদের সেক্টরে হোক কিংবা সেক্টরের বাইরে হোক বিদেশি কিংবা দেশি হোক যেকোনো নাগরিকের ক্ষেত্রেও আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। বিদেশিদের ক্ষেত্রে আরও সিরিয়াস হতে হবে। পোল্যান্ডের বায়ার আমাদের সেক্টরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই ঘটনার সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্তের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করছি।’-যোগ করেন সৈয়দ নজরুল।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ৫৮ বছর বয়সী বিদেশি ওই নাগরিক ফ্যাশন রিটেইলার প্রতিষ্ঠান বিগ স্টার লিমিটেডের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার ছিলেন। তিনি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান কেনপার্ক বাংলাদেশ অ্যাপারেল প্রাইভেট লিমিটেড পরিদর্শনে আসেন। প্রতিষ্ঠানটির মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার আশরাফুল হক ডালিম তাকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রিসিভ করে নগরের জিইসি মোড়ে হোটেল পেনিনসুলায় নিয়ে আসেন। হোটেলের ৯ম তলার ৯১৫ নম্বর কক্ষে ওঠেন পোলিশ নাগরিক জিদজিসোয়াহ মিশেল জেরিবা। তিনি ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকেই ওই হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তাকে ৪ মার্চ সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে আশরাফুল হক ডালিম ব্যবসায়িক কাজে ফোন করে না পেয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানান বিষয়টি। হোটেল কর্তৃপক্ষ ৯১৫ নম্বর রুমের সামনে গিয়ে ডু নট ডিস্টার্ব (Do Not Disturb) লেখা কার্ড ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। পরবর্তীতে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের পর থেকে তার দরজায় নক করা হলে কোনো সাড়াশব্দ মেলেনি। এতে সন্দেহ হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ চকবাজার থানা পুলিশকে ১১টার দিকে জানায়। খবর পেয়ে সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। তারপর হোটেল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় কক্ষের দরজা খুললে দরজার পাশে জিদজিসোয়াহ মিশেল জেরিবার রক্তাক্ত মরদেহ দেখতে পায় পুলিশ। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর ওইদিন বিকেলে পোস্টমর্টেমের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
হোটেল পেনিনসুলার ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সবশেষ ২ মার্চ বিকাল ৫টা ১২ মিনিটে নিজের রুমের ভেতর থেকে দরজা খুলে রুম সার্ভিস বয়কে খাবারের খালি ট্রে ফেরত দিতে দেখা গেছে ওই বিদেশি নাগরিককে। এরপর থেকে ৪ মার্চ সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে তাকে আর রুম থেকে বের হতে দেখা যায়নি।
জিদজিসোয়াহ মিশেল জেরিবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ছুটে আসেন বিগ স্টার লিমিটেডের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার পার্থ প্রতীম ঘোষ। তিনি এসে লাশ শনাক্ত করেন। পরবর্তীতে ওইদিন দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি/ব্যক্তিদের বিবাদি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তিনি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি/ব্যক্তিরা গত ২ মার্চ আনুমানিক ৫টা ১২ মিনিট থেকে ৪ মার্চ সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় জিদজিসোয়াহ মিশেল জেরিবার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করে পালিয়ে গেছে। বিগ স্টার লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জিদজিসোয়াহ মিশেল পরিবারের সাথে আলাপ করেই তিনি মামলাটি দায়ের করেন বলে জানান।
বিদেশি নাগরিক হওয়ায় জিদজিসোয়াহ মিশেল জেরিবার পোস্টমর্টেম সম্পন্ন করতে পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। ৫ মার্চ মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
হোটেল কক্ষ থেকে মরদেহ উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে শেষে বলেছিলেন, ‘নিহত বিদেশি নাগরিকের মাথার পেছনে ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পুরো রুমটি রক্তাক্ত ও এলোমেলো অবস্থায় ছিল।’ প্রাথমিকভাবে তখন এটিকে হত্যাকাণ্ড হতে পারে বলে সন্দেহের কথা জানান তিনি। বলেন, ‘মরদেহের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, জব্দ করা আলামত এবং অন্যান্য তথ্যউপাত্ত যাচাই-বাছাই শেষে এটি হত্যাকাণ্ড কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।’ এ ঘটনায় পুলিশের বিশেষ ইউনিটগুলো কাজ করছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।