জাতীয়

১৫৭ দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ

৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের ওষুধ বিদেশে যাচ্ছে। ১৯৯৩ সালে প্যারাসিটামল গ্রুপের নাপাসহ ১৮ ধরনের ওষুধ রাশিয়ায় পাঠানোর মাধ্যমে রপ্তানির পথ খুলেছিল বেক্সিমকো ফার্মা। পরের বছর যুক্ত হয় আরও কয়েকটি কোম্পানি; অপসোনিন, স্কয়ার প্রভৃতি কোম্পানি গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ রেনিটিডিন রপ্তানি করে। এরপর রপ্তানিকারক কোম্পানিও বেড়েছে, ওষুধের সংখ্যাও বেড়েছে। বেড়েছে আমদানিকারক দেশের সংখ্যা এবং রপ্তানি আয়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ওষুধ শিল্প সমিতি, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও ওষুধ শিল্পের গবেষকরা জানিয়েছেন, ১০ বছর আগেও আমদানিকারক দেশের সংখ্যা ছিল ৯০, এখন ১৫৭। ভ্যাকসিন বাদে বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রায় সব ধরনের ওষুধই বিদেশে যাচ্ছে। সচল ২১৩টি কোম্পানির ৫০টিই রপ্তানি করছে।

স্বাধীনতার পর দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হতো। স্থানীয় কোম্পানিগুলো মাত্র ২০ শতাংশ চাহিদা মেটাত। এখন মোট চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদিত হয়। চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হয়।

গত ১৬ বছরে রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ছয়গুণ। ২০০৭ সালে রপ্তানি আয় ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ২৯৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা, গত অর্থবছরে আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলার বা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকায়।

ওষুধ রপ্তানিতে এশিয়ায় বাংলাদেশ পঞ্চম অবস্থানে। স্বল্পোন্নত ওষুধ রপ্তানিকারক দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বিদেশে কারখানা স্থাপন করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানা।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও হাডসন ফার্মার স্বত্বাধিকারী এসএম শফিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ওষুধ রপ্তানির কাজ খুব কঠিন। এখন বিশ্বের অবস্থা খারাপ। দেশে দেশে যুদ্ধের কারণে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তারপরও আমরা রপ্তানি করছি। আমেরিকায়ও ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।

আমদানিকারক দেশের সংখ্যা বাড়ছে। এটা আশাপ্রদ। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎকৃষ্ট ওষুধ উৎপাদন করছে।’

রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণের বেশি : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে ২৯৬ কোটি টাকার রপ্তানি আয় বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আয় বেড়েছে সাড়ে ছয়গুণেরও বেশি।

২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে গত ১৬ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই আয় বেড়েছে। গত অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি আয় ৭ শতাংশ কমে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে এটি ছিল ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ও ডলার সংকটের কারণে এ আয় কমেছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

গত ১৬ বছরের মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার বা ১ হাজার ৯৮২ কোটি ১৯ লাখ টাকার ওষুধ রপ্তানি হয়েছে।

দেশে বেড়েছে দেড়গুণের বেশি : বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ৯০টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হতো। এখন হচ্ছে ১৫৭টি দেশে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে আমদানিকারক দেশের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

আমদানিকারক দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, আজারবাইজান, ভুটান, কম্বোডিয়া, চীন, হংকং, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান, জর্ডান, জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ম্যাকাও, নেপাল, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইয়েমেন, তাইওয়ান, মালদ্বীপ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিন, লেবানন, কুয়েত, কাতার, ওমান, উপসাগরীয় দেশসমূহ (জিসিসি), তুর্কমেনিস্তান কাজাখস্তান, বাহরাইন, ব্রুনাই, দারুস সালাম, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলদোভা, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল রাশিয়া, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া, স্লোভাকিয়া, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, মেসিডোনিয়া, বসনিয়া, সান মারিনো, শাদ, মিসর, কেনিয়া, লিবিয়া, লাইবেরিয়া, মরিশাস, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, সোমালিয়া, সোয়াজিল্যান্ড, তানজানিয়া, তিউনিসিয়া, টোগো, উগান্ডা, জ্যামাইকা, লাওস, জাম্বিয়া, মেক্সিকো, হাইতি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মন্টিনেগ্রো, নিকারাগুয়া, পানামা, সামোয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভেনেজুয়েলা, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে প্রভৃতি।

আমদানির শীর্ষে মিয়ানমার : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৮৯ কোটি টাকার সবচেয়ে বড় চালানটি গেছে মিয়ানমারে, যা মোট ওষুধ রপ্তানির ১৫ শতাংশ। তবে দেশটির চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ পূরণ করেছে বাংলাদেশ।

ওষুধ রপ্তানিতে এরপরই রয়েছে শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশগুলোতে ওই অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি হয়েছে যথাক্রমে ২ কোটি ৩২ লাখ ডলার বা ২৪৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২ কোটি ২৬ লাখ ডলার বা ২৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা ও ১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার বা ১৪০ কোটি ৭০ লাখ টাকার। আগের অর্থবছরেও বাংলাদেশের ওষুধের আমদানির শীর্ষে ছিল মিয়ানমার।

ওষুধ রপ্তানিকারকরা রপ্তানির তালিকায় নতুন নতুন ওষুধ যুক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন। বাংলাদেশের ৯টি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়ার ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে।

বাজার বেড়েছে তিনগুণের বেশি : ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত উপপরিচালক নুরুল আলম বলেন, দেশে প্রায় ২৬৫টি নিবন্ধিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে সচল ২১৩টি কোম্পানি ১ হাজার ৩০০-এর বেশি জেনারের সাড়ে ২৫ হাজারেরও বেশি ওষুধ তৈরি করছে। এসব ওষুধের বাজারমূল্য ৪০ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০১৪ সালে ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার। অর্থাৎ গত ১০ বছরে ওষুধের বাজার বেড়েছে তিনগুণের বেশি।

এশিয়ায় শীর্ষ পাঁচে বাংলাদেশ : ওষুধ শিল্প সমিতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে ওষুধ রপ্তানিতে বাংলাদেশ ওয়ান অব দ্য পাইওনিয়ার। এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। আমরা শ্রীলঙ্কার ৬০ শতাংশ ওষুধের জোগান দিই। আফগানিস্তান ও সৌদি আরবেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ।’

বিদেশেও গড়ে উঠছে কারখানা : ওষুধ শিল্প সমিতির প্রধান নির্বাহী জানান, কেনিয়াতে স্কয়ারের কারখানা আছে। বেক্সিমকো সৌদি আরবে একটা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে। ফিলিপাইনে স্কয়ারের কোম্পানি আছে। মেজর জেনারেল (অব.) মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে ওষুধ শিল্পে লোকবলের ঘাটতি নেই। ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসিস্ট তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশি ফার্মাসিস্ট, বায়োকেমিস্ট, ব্যাকটেরিওলজিস্ট দিয়ে বিদেশের অনেক কোম্পানি তাদের কারখানা চালাচ্ছে। বিদেশে শিক্ষিত লোকজনের চাকরির একটা বড় জায়গা ওষুধ শিল্প।’

এখনো হয়নি এপিআই পার্ক : মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ওষুধের কাঁচামাল তৈরির জন্য অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) পার্ক স্থাপনের কাজ ২০১২ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সেটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি বলে জানিয়েছেন এসএম শফিউজ্জামান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ১০ বছর ধরে চেষ্টা করছি। কোম্পানিগুলো টাকাও দিচ্ছে। কিন্তু সরকার বিদ্যুৎ-গ্যাস দিতে পারছে না। পার্কটি হয়ে গেলে দেশের অনেক ওষুধ কোম্পানি নিজেদের ব্যবসায়িক কর্মকা-ে প্রসার ঘটাতে পারত।’

ওষুধকে স্বাস্থ্যের লেন্সে দেখার পরামর্শ : ওষুধকে শিল্প হিসেবে না দেখে স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে উৎপাদিত মোট ওষুধের ৮৫-৯০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় স্থানীয় বাজারে। ১০-১৫ শতাংশ রপ্তানি হয়। ওষুধকে দেখতে হবে স্বাস্থ্যের লেন্স দিয়ে, শিল্পের লেন্স দিয়ে নয়। মানুষ মানসম্মত ওষুধ পাচ্ছে কি না, ওষুধ সহজলভ্য কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ১ হাজার ৩০০ রকম ওষুধ আছে। মাত্র ৪০টি ওষুধের এপিআই (কাঁচামাল) বাংলাদেশে তৈরি হয়। বাকি সব বাইরে থেকে আসে। তবে প্রতিনিয়ত আমরা স্বাবলম্বী হচ্ছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *